দূরের দূরবীনে-রিকি পন্টিং ও রিকশার বিশ্বজয় by অজয় দাশগুপ্ত

রাজনীতির বাইরেও বর্ণিল তাঁর স্বপ্নময় একটা জগৎ আছে। দুঃখ এই, আমাদের রাজনীতি তা বুঝতে দেয় না। মানতেও চায় না। এ কথা মানতে হবে, রাজনীতিই চালিকাশক্তি, দুনিয়ার সব দেশে, সব রাষ্ট্র ও সমাজে তার ভূমিকা চালকের। পার্থক্য এই, সভ্য ও উন্নত নামে পরিচিত গণতান্ত্রিক দেশে সে সর্বগ্রাসী বা সর্বভুক নয়।


তার জায়গায় সে কখনো ব্যাঘ্র, প্রয়োজনে হরিণ শাবক। আমাদের দেশের রাজনীতি অথবা বলা উচিত দলীয় প্রাধান্য, সিংহাসন থেকে এক পা নামতেও নারাজ। ওই আসনের নামে সিংহ হয়ে থাকাটাই তার পরম আরাধ্য। ফলে জীবনের নানা ক্ষেত্র, নানা বর্ণ ও আলোর ঔজ্জ্বল্য প্রায়ই চোখে পড়ে না। তাই বছরের পর বছর ঘানি টানার মতো জঞ্জাল আর ক্লেদ নিয়ে বেঁচে থাকা। সৌভাগ্য আমাদের, এর পরও কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন অথবা ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ হয়। বাঙালি চিরদিনই দ্রোহে উজ্জ্বল, ভাঙচুরে শক্তিমান, আর বিপদে উত্তীর্ণ হওয়ার জাতি। একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও কেড়ে আনতে পারে জয়ের শেষ বরমাল্য। বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখির অপার শক্তিতে বিশ্বাসী আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ক্রীড়া, আমাদের জীবন তাই থেমেও থাকে না। তার চলার ছন্দে নূপুর আছে কি নেই তা বড় নয়, সে চলে। চলতে চলতে একসময় পেঁৗছে যায় ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে আরো এক বিশাল ও উদার জমিনে।
পেঁৗছে তো বটেই। সকালের সিডনি মর্নিং হেরাল্ড খুলে দেখি ঝকঝকে চেহারা আর ঝাঁ চকচকে স্যুট-বুটের রিকি পন্টিং। তাও রিকশায়। বলে নিই, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া ইংরেজের জাত ভাই, সহোদর তুল্য, তার বহিরাঙ্গিকে উদার উদার ভাব থাকলেও ভেতরে হিংসুটে। অস্ট্রেলিয়ানদের ধারণা, শ্রেষ্ঠত্ব তাদের স্বভাব-ধর্ম। খুব বেশি দিনের ইতিহাস বা ঐতিহ্য নেই বলে অতীতের শক্তি বা ভিত্তির ওপর বিশ্বাসও নেই। থাকবে কী করে? ইংল্যান্ড থেকে ছিঁচকে চোর, তস্কর বা দাগি নামে পরিচিতরাই নির্বাসনের জন্য খুঁজে নিয়েছিল এ দেশ। তারপর আদি অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে মারামরি, খুন, জখম আর লুণ্ঠনের কালো ইতিহাস, আধিপত্যের নানা রং, নানা বর্ণ। অস্ট্রেলিয়ানদের ভেতরও সে ধারা প্রবহমান। থাকতে থাকতে অভিবাসী আমাদের চরিত্রেও সে বেনো জল প্রবেশ করছে। আমার এক তরুণী বন্ধু প্রায়ই অভিযোগ করেন, স্বভাবে হিংসুটে আর বেপরোয়া বলে আমি চুপ থাকি, মনে মনে ভাবি যস্মিন দেশে যদাচার বলে কথা। এ দেশের মিডিয়ার কথায় ফিরে আসি, এই কিছু বছর আগেও কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেইসবুক ছিল না। বাহন ছিল কাগজ অথবা রেডিও-টিভি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলার ফলাফল জানা অদম্য কৌতূহলে কাগজ তন্ন তন্ন করে ফেলতাম। না, নেই, কোথাও কোনো খবর নেই, থাকলেও তা এত সংক্ষিপ্ত, এতটা ক্ষুদ্র আকারে, শ বা পঞ্চাশ পৃষ্ঠার দৈনিক থেকে তা খুঁজে পাওয়া রীতিমতো পরিশ্রমের ব্যাপার। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টিভি অন, খবরের পর খবর, স্পোর্টস নিউজ, না কোথাও নেই সত্য। কোথায় পালালেন তিনি?
পরে জানলাম, বলা উচিত বুঝে নিলাম, এর একটা মাজেজা আছে। মাজেজাটা এই, খবর না থাকলে বুঝতে হবে প্রতিপক্ষ জিতেছে। আর যদি অস্ট্রেলিয়া জেতে তাহলে প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠাজুড়ে খবরের ছড়াছড়ি। এর মনোজাগতিক কারণও এখন পরিষ্কার। এ দেশটির অস্তিত্ব আর পরিচয়ের সূত্রই খেলাধুলা, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা বা ইতিহাসে তার স্থান ধীরে বহা মেঘনার মতো। নয় সে পদ্মার মতো উদ্দাম, গঙ্গার মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত বা যমুনার মতো ভাঙনপ্রবণ। একা ব্র্যাডম্যান ব্যতীত তেমন আর কোনো আইকনও নেই, অথচ দুই কোটির অল্প অধিক জনসংখ্যার দেশটি বিশ্ব ক্রীড়ায় একেবারে প্রথম কাতারে। এত অল্প মানুষের দেশের পক্ষে এত খেলায় আধিপত্য ও জয়ের ধারাবাহিকতা বিস্ময়ের। আমার ধারণা, এই অহংবোধ বা অর্জনটুকুতে এ জন্যই এরা স্পর্শকাতর।
অস্ট্রেলিয়া ধনী বলে সে যেসব খেলাধুলায় জড়িয়ে সেগুলো দাতা দেশও বটে। ফলে তার বিগ ব্রাদার-সুলভ মনোভাবও ফেলনার নয়। এসব কারণে বঙ্গ দেশের বিশ্বকাপ উদ্বোধনীকে এরা কিভাবে দেখে তা নিয়ে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। রিকি পন্টিং ও রিকশার ছবি দেখে কৌতূহলী মন পা বাড়াল কাগজের অন্দরমহলে। বর্ণাঢ্য ছবি, ঝলমলে উদ্বোধনীর মনকাড়ানিয়া খবর। এই তো ভাঙছে খোলস। ভাঙছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, মহামারি, দুর্নীতি আক্রান্ত নামে পরিচিত দেশের ভয়াবহ ইমেজ। বলে সব কিছু বোঝানো যায় না, বোঝানো অসম্ভব লেকচার ও বক্তৃতায়, লিখে তো নয়ই। আজকের দুনিয়া কাজে বিশ্বাসী। এ দেশের আপ্তবাক্য সিয়িং ইজ বিলিভিং, যা দেখি তাই বিশ্বাস করি। সেটাই দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তার পরও কথা থাকে। সহকর্মী, বন্ধু, অস্ট্রেলিয়ান সতীর্থরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনতে শুরু করেছেন। খুলে যাচ্ছে সম্ভাবনার নতুন খিড়কি, কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথামালা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেন এত বক্তৃতা? কেন এই ভাষণের পর ভাষণ! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আইসিসি প্রধান শারদ পাওয়ারই কি যথেষ্ট ছিলেন না? পাওয়ার সাহেব অবশ্য তালগোল পাকিয়ে কী বলেছেন, তার মর্মার্থ উদ্ধার ভেতো বাঙালির পক্ষে বার করাই অসম্ভব। অসিরা তো কোন ছাড়। এক বন্ধু বলছিলেন, ভাষণে ইংরেজি বললেও সাবটাইটেল না থাকায় এক বর্ণও বোঝা যায়নি। অ্যাকসেপ্ট বলে কথা, এ জন্যই বলে, 'বিনা স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা'? স্বদেশি ভাষার নির্যাস আর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে গর্ব করি আমরা। ভাষার নামে সে গর্ব, অহংকারের শিখা পেঁৗছে যায় দিগন্তের শেষ কোনায়। তবু ওই যে ঔপনিবেশিকতা, উপনিবেশের দায়ভার, মাতৃভাষায় বলতে দেয়নি। অথচ বিশ্বকাপের উদ্বোধন হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। যে মাসে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে জাতিসংঘ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি।
এ ব্যর্থতার জন্য আমি দায়ী করব রাজনীতিকে। রাজনীতি কিছু বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। তার ধারণা, সে যা করছে তা-ই শ্রেষ্ঠ, তা-ই চূড়ান্ত।
খেলাধুলার বিশ্বজয় এবং তার রেশও বিস্তৃত সুদূরগামী। ক্রিকেটের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে প্রশান্ত পাড়ে। শুধু কি ক্রিকেট? যে রিকশা, মানুষচালিত যানের প্রতি কটাক্ষ আর বদনজর, সেও উঠে এসেছে আপন মহিমায়।
রিকশা, রিকি পন্টিং, উপবিষ্ট বালকটি যেমন এসেছেন, তেমনি এসেছেন রিকশাওয়ালাও। এই তো আমাদের গর্ব। জাতীয় পরিচয়, পৃথিবীতে ধনসম্পদে পিছিয়ে থাকা কষ্টের ও অপমানের, কিন্তু তার চেয়েও বড় দুঃখ আত্মপরিচয়হীন হয়ে বেঁচে থাকায়। আমরা সেদিক থেকে ধনী। অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এক শ গুণ এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান নামে পরিচিত ইংরেজ ইউরোপিয়ান শাসনের অর্থনৈতিক ভিত্তি যে সম্পদ, তা তার নিজস্ব কিছু নয়। সে কেবল পরিকল্পনা ও গণতান্ত্রিক শাসনের ধারক মাত্র। এই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানও এ দেশের নিজস্ব, মাটির তলা থেকে উৎপাদিত পণ্যে সে স্বাক্ষর, সে চিহ্ন সূর্যের মতো জ্বলজ্বলে। ইংরেজ জীবনে জবা ফুল দেখেছে? প্রশাস্ত পাড়ের আইরিস বালিকা সে ফুল খোঁপায় গুঁজে ঘুরে বেড়ায়। কারণ এ দেশটির মাটিতে লাল রং জবা জন্মায়।
একেই বলে আদি, অকৃত্রিম ও নিজস্ব, আমরা অকৃত্রিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বলীয়ান এক জাতি, ক্রিকেট আমাদের সে পরিচিতিকে রিকশায় তুলে পেঁৗছে দিয়েছে প্রশান্ত পাড়ে। জানলাম, সমুদ্র যান বা আকাশ যানে শুধু নয়, রিকশায়ও জয় করা যায় বিশ্ব ভুবন, জয়তু বাঙালি, বাংলাদেশ ও তার ক্রিকেট।

লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.