ছাত্রলীগ অগি্নঝরা সেই দিন থেকে এখন by শ, আ, মোঃ সোহানুর চৌধুরী সোহাগ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, একটি নাম, একটি বিস্ময়। যার রয়েছে বর্ণাঢ্য অতীত, রয়েছে ইতিহাস। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন এই ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির ধারক ও বাহক ছাত্রলীগ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে।


অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই ছাত্র সংগঠনটির মধ্য দিয়েই এদেশে অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা।
এই সংগঠনের রয়েছে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, যে আন্দোলন ইতিহাস হয়ে আছে গৌরবের উজ্জ্বল আলোতে। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা আমাদের দেশের জন্য অনেক গৌরবের বিষয়। '৬৬ সালের ৬ দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র রাজনীতির আলোর শিখায় আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে '৬৯-এর গণঅভু্যত্থানে। তার পর '৭০-এর নির্বাচন, আইয়ুব শাহীর পতন, অবশেষে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে '৭১ সালের যে মহান মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত যাঁরা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত জীবনে একেকজন রাজনৈতিক মহীরূহ। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতা-পূর্ব ছাত্রলীগের রাজনীতির কথা মনে হলে গর্বে বুক ভরে যায়। ছাত্রলীগের মধ্য দিয়েই একদা অভিষেক ঘটেছিল শেখ ফজলুল হক মণি, শেখ কামাল, তোফায়ের আহমেদ, আ স ম রব, নূরে আলম সিদ্দিকী লিটন,সিরাজুল আলম খান, আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, শেখ জাহিদ হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মনির উদ্দীন আহমেদ প্রমুখ ঐন্দ্রজালিক দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের। তাঁরা রাজনীতি করেছিলেন আদর্শের, রাজনীতি করেছিলেন মানুষের কল্যাণের। তাঁদের স্বপ্ন ছিল শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার, স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশের। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা এদেশের ইতিহাসে চরিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ইতিহাসের অনেকপথ পাড়ি দিয়ে আজ ছাত্রলীগের অবস্থান কোথায়? পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। বিগত ২০০১-এর খালেদা-নিজামীর জোট শাসনের নির্মম নির্যাতনে নি্ে#৬৩৭৪৩;ষিত হয়ে মানুষ তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ মহাজোট সরকারকে বিজয়ী করেন। কিন্তু নির্বাচনের পর পরই আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন (পরে সহযোগী সংগঠন) ছাত্রলীগ, জোট আমলের সৃষ্ট তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রদল এবং ঘাতক দালাল জামায়াতের শিবির বাহিনীর মতো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পরপরই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলের নেশায় মেতে ওঠে ছাত্রলীগ। অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সব প্রধান শিক্ষাপীঠ।
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ নির্বাচনের পর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমি দেখেছিলাম হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর ঢল। যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নাম পর্যন্ত নেয়া যেত না, প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল মৌলবাদী সংগঠনগুলো। কিন্তু আমি সন্দিহান এবারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পাঁচ শ' ছাত্রছাত্রী হবে কিনা! কারণ শুধু একটাই ছাত্রলীগের আচরণ, ছাত্রলীগের চরিত্র। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। মেধাবী, সৎ, চরিত্রবান ছাত্রদের পক্ষে কখনও কোন মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী, মোবাইল ছিনতাইকারী, ছাত্র নিপীড়নকারীকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়া খুবই কঠিন। তাই সংগঠনটির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন সংস্কারের। ছাত্রলীগের এই করুণ পরিণতির জন্য বহুলাংশে দায়ী সংগঠনটির অব্যবস্থাপনা। বছরের পর বছর কমিটি না হওয়া, বিবাহিত, অছাত্র, সন্ত্রাসী, মাদকাসক্ত, বয়স্ক নেতৃবৃন্দই এর জন্য দায়ী।
মাননীয় প্রধামন্ত্রী গণতন্ত্রের মানস কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ভিশন ২০২১ পূরণের লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মাননীয় নেত্রী ডিজিটাল দেশ গড়ার জন্য ডিজিটাল মানুষের প্রয়োজন, ডিজিটাল কমর্ীর প্রয়োজন। তাই অবিলম্বে ছাত্রলীগের জন্য কিছু ডিজিটাল সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
সর্ব প্রথম কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারা দেশের প্রতিটি থানা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করা দরকার। কারা ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, টেন্ডার ও ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিরপেক্ষ ছাত্র প্রতিনিধিদের দিয়ে তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে কেন্দ্রীয়ভাবে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। সন্ত্রাস নিমর্ূলের জন্য আপনি আপনার গত আমলে প্রেসনোট জারি করে অব্যাহতি দিয়েছিলেন, সন্ত্রাসী মুরগি মিলন, মতিউর রহমান রেন্টু, আওয়াঙ্গকে, তাহলে বর্তমান সময়ে কেন পারবেন না?
ছাত্রলীগের জন্য একটি যুগোপযোগী কার্যকর গঠনতন্ত্র দরকার। যাতে কোন অছাত্র, ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, বয়স্ক, মাদকাসক্ত, শিক্ষা জীবনে বার বার ইয়ার লস দেয়া আদু ভাই নেতৃত্বে আসতে না পারে। দরকার সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগের কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল। যে সেলের দেখভালের জন্যে সাহায্য নেয়া যেতে পারে সাবেক পরিচ্ছন্ন সৎ ও চৌকস ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের। তবে এটিও মনে রাখা দরকার মনিটরিংয়ের নামে যেন কোন একক ব্যক্তির হাতে ছাত্রলীগের দায়িত্ব তুলে না দেয়া হয়। কারণ বিগত সময়ে ও, কে কমিশনের বিরুদ্ধে দুনর্ীতির অনেক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ড, থানা, জেলা থেকে ছাত্রলীগের সকল নেতাকমর্ীর তথ্য সংগ্রহ করে যেন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। কম্পিউটারের বাটন টিপলেই যেন সকল তথ্য সামনে চলে আসে। নির্দিষ্ট সময়ে যেন গণতান্ত্রিক নিয়মে দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের দুর্বলতার সুযোগ যেন কোন মৌলবাদী সংগঠন নিতে না পারে। আমাদের অমনোযোগিতার কারণে দেশের আর কোন তরুণ যেন বিপথগামী না হয়, দীক্ষা না নেয় জঙ্গীবাদের, মৌলবাদের। অথচ আমাদের যা আছে তা তাদের নেই। আমাদের আদর্শ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বরপুত্র স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর আদর্শ এখনও তরুণদের অনুপ্রাণিত করে। যার জ্বালাময়ী বক্তব্য তরুণ হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণন তোলে দেশপ্রেমের। যাঁর বক্তব্যে হ্যামিলনের সেই বংশীবাদকের মতো এখনও বাংলার হাজার হাজার ছাত্র সমাজ এসে দাঁড়ায় ছাত্রলীগের পতাকাতলে, জয় বাংলা ডাকে। কিছু উচ্ছৃক্মখল মানুষের জন্য গৌরবের সংগঠনটি নষ্ট হয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো নিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করে দিয়ে একটি ডিজিটাল ছাত্রলীগ বিনির্মাণ করে দিয়ে যেতে পারলে ছাত্রলীগের ইতিহাসে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর যদি ব্যর্থ হন মনে রাখবেন ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রলীগের ব্যর্থতার দায়ভার আপনাকেও নিতে হবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নেত্রী হিসেবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমরা আশা রাখি, সকল সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে আপন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে ছাত্রলীগ।
লেখক : ছাত্র, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.