মানসিক রোগে শারীরিক লক্ষণ by ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন

মাহবুবের বয়স ২৫ বছর। হঠাৎ মাঝে মধ্যে তার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় হাত-পা অবশ হয়ে আসা, বুকে ব্যথা করা। ক্রমশ তার হাত-পা ঠা-া হয়ে আসছিল। মনে হয় এখনই মরে যাবে। এই ধরনের রোগীরা একটার পর একটা ইসিজি আর ইকোকার্ডিওগ্রাম করতে করতে তার চিকিৎসা ফাইল অনেক বড় করে ফেলেন।
ডাক্তারও বদলাতে থাকেন তার রোগ ধরতে পারছে না বিধায়। এর মধ্যে রোগীর গায়ে কিন্তু বড় অসুখের সিল পড়ে গেছে। আর আত্মীয়স্বজনরা বলতে থাকে ওকে কোনো বড় কাজে দিও না। ওর বড় জটিল অসুখ। আসলে এটি একটি টেনশন বা অস্থিরতা গ্রুপের রোগ যাকে আমরা প্যানিক ডিজঅর্ডার বলে থাকি।
রোগীদের ভাবনা :
১। তার হার্টের অসুখ এজন্য বার বার ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম করে বেড়াচ্ছে।
২। মাথা ঝিমঝিম করছে-মানে স্টোক করে ফেলবে।
৩। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে মনে হয় প্যারালাইসিস হয়ে যাবে।
৪। যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি হয়। সব বয়সেই হতে পারে তবে ১৫-২৫ এবং ৪৫-৫৫ বয়সে বেশি হয়। বিপতœীক বিধবা, স্বামী-স্ত্রী দু’জনে আলাদা হয়ে যাওয়া এ ধরনের পারিবারিক পরিস্থিতিতে বেশি দেখা দেয়। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারানো এবং বড় ধরনের মানসিক আঘাত পাওয়া-এদের মধ্যে প্যানিক ডিজঅর্ডার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদি কোনো শিশু ৫ বছরের আগে যৌন হয়রানির শিকার হয়। কম শিক্ষিত লোকদের মধ্যে তুলনামুলকভাবে বেশি দেখা দেয়।

কীভাবে বুঝবেন যে প্যানিক
ডিজঅর্ডার রোগে ভুগছেন

১। হঠাৎ করে বুক ধড়ফড় করা, শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়া, মাথা ঝিমঝিম করা।
২। দম বন্ধ হয়ে আসা, বড় বড় করে হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া।
৩। হাত-পা অবশ হয়ে আসা। শরীরের কাঁপুনি হওয়া।
৪। বুকের মধ্যে চাপ লাগা এবং ব্যথা অনুভব করা।
৫। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো রোগী বলে হঠাৎ পেটের মধ্যে একটা মোচর দেয় তারপর ওপর দিকে উঠে বুক ধড়ফড় শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। আর কথা বলতে পারে না।
৬। বমি বমি ভাব লাগে। পেটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ লাগা ও গলা শুকিয়ে আসা।
৭। পেটের মধ্যে গ্যাস ওঠে, খালি গ্যাস গ্যাস উঠে এবং বুকে চাপ দেয়।
৮। দুশ্চিন্তা থেকেও মাথাব্যথা হতে পারে কোনো কোনো রোগী বুকে ব্যথা ও হাত-পায়ের ঝিমঝিমকে হার্ট এ্যাটাকের লক্ষণ মনে করে প্রায়ই ছুটে যান হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার দেখাতে।
৯। মৃত্যু ভয় দেখা দেয়া মনে হয় যেন এখনই মরে যাবেন রোগ যন্ত্রণায়।
১০। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।
১১। বার বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া/ইসিজি করা।
১২। দূরে কোথাও গেলে স্বজনদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যায় যেন মাঝখানে অসুস্থ হলে ধরতে পারে।
১৩। নামাজ পড়তে গেলে একপাশে দাঁড়ায় যেন অসুস্থ হলে তাড়াতাড়ি বের হতে পারে।
১৪। রোগীদের মধ্যে ভয় কাজ করে এই বুঝি আবার একটি এ্যাটাক হতে পারে।
১৫। রোগের লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই শুরু হয় ১০ থেকে ২০ মিনিট পর কমে যায়।
১৬। সেফটি বিহেভিয়ার যেমন এ্যাটাকের সময় বসে পড়া, কোনো কিছু হাত দিয়ে ধরে সাপোর্ট নেয়া ইত্যাদি লক্ষণ রোগীর মাঝে দেখা দেয়। যা কি-না হৃদরোগীদের মাঝে লক্ষণীয় নয়।

কী কী পরিণতি হতে পারে
১। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করলে, এ ধরনের রোগী ডাক্তারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সর্বস্বান্ত হয় এবং সব শেষে নিজে একজন হার্টের রোগী বলে কাজকর্ম ছেড়ে দেয়।
২। বিষণœতায় ভুগতে পারে।
৩। নেশায় জড়িয়ে যেতে পারে।
৪। এগোরেফোবিয়া নামক আরো একটি সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। তখন রোগীরা বাইরে বের হতে, হাটবাজার রেস্টুরেন্ট ক্যান্টিন ইত্যাদি জায়গায় যেতেও ভয় পায়।
৫। ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
৬। আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসতে পারে।
৭। সর্বোপরি এই মানুষটি আর সমস্যার কারণে পরিবার সমাজ ও জাতির বোঝা হয়ে যেতে পারে।

চিকিৎসা
নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো। রোগীকে আশ্বাস দেয়া। নির্দিষ্ট সময়ান্তে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। সঠিক সময়ে সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে চিকিৎসা করলে এসব রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
যোগাযোগ : ০১৮১৭০২৮২৭৭

No comments

Powered by Blogger.