ইউনিপেটুইউর প্রতারণা-কর্মসূচি দিয়ে উল্টো বিপাকে প্রতারিত গ্রাহকরা

'আমরা পাওনা টাকা ফেরত পাচ্ছি না। মামলাও করতে পারছি না। কিছু লোক কাউকে বলতেও পারছি না। দেখেন, কেমন বিপদে পড়ছি!' মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি ইউনিপেটুইউর প্রতারণার শিকার এক গ্রাহক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল সোমবার প্রতীকী অনশন কর্মসূচি চলাকালে আক্ষেপ করে এসব কথা বলেন।


তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমার মতো অনেক বিনিয়োগকারী এখন পথে বসেছে। কেউ সেনা কর্মকর্তা, কেউ চিকিৎসক আবার কেউ সরকারি চাকরিজীবী। কিছু লোক এখন আন্দোলন করছে। তবে প্রতারণার শিকার ছয় লাখ গ্রাহকের বেশির ভাগই নানা কারণে আন্দোলনে সামনে আসছে না।'
টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে গতকাল এ কর্মসূচি চলাকালেই ইউনিপেটুইউর ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন গ্রাহক মহানগর হাকিম আদালতে সাত বিনিয়োগকারীর জামিনের চেষ্টা করছিলেন। গত রবিবার মিছিল থেকে আটক করা সাত বিনিয়োগকারীকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। ইউনিপেটুইউর প্রায় ৭০০ বিনিয়োগকারীকে আসামি করে রমনা থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রমনা থানার ওসি শাহ আলম কালের কণ্ঠকে জানান, বেআইনভাবে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে এ মামলা করা হয়েছে।
গতকাল মহানগর হাকিম আদালতে সাত আসামির জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত চার নারী আসামির জামিন মঞ্জুর করেছেন। আদালত ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন রবিন, সদস্য মোহাম্মদ জামাল ও সোহানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
অনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা জানান, এমএলএম প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার পর এখন উল্টো বিপদে পড়েছেন তাঁরাই। দেড় বছর ধরে পাওনা টাকা ফেরত পাওয়ার দাবি করে আসছেন ভুক্তভোগীরা। ছয় লাখ গ্রাহকের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্র। মামলা করার পর প্রতারকচক্রের কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও অন্যরা এখনো আড়ালে। গত বছর সরকার ইউনিপেটুইউর ৪১৯ কোটি টাকা জব্দ করেছে। তবে এক বছরেও ওই টাকা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। একের পর এক আলটিমেটাম দিয়ে দাবি জানালেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ দফা দাবিতে অর্থমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন তাঁরা।
ইউনিপেটুইউর গ্রাহকরা বলছেন, পাওনা টাকা দাবি করায় প্রতারকচক্রের ইন্ধনে তাঁদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে সরকারের একটি মহল। অন্যদিকে ইউনিপেটুইউর প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। দায়ের করা ২৮টি মামলার মধ্যে মাত্র একটির চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। অনেক আসামি দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনের উদাসীনতায় কেউ কেউ বিনা বাধায় দেশ ছেড়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, এখন দেশের কোনো থানায় ইউনিপেটুইউর অভিযুক্ত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছে না পুলিশ।
ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাবের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শাহিন সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্রাহকরা পাওনা টাকার জন্য তাঁদের কাছে ভিড় করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, 'আমাদের এ বিপদ থেকে আপনি রক্ষা করুন। আমরা টাকা ফেরত চাই। প্রতারকচক্রের বিচার করুন।'
ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাবের সভাপতি সরওয়ার মোরশেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার ছয় লাখ গ্রাহকের স্বার্থ দেখছে না। দেখছে প্রতারকদের স্বার্থ। আমরা ন্যায়বিচার চাই। চক্রটি হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। তাদের বিচার চাই আমরা। জব্দকৃত টাকা আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। না হলে আমরা রাজপথ চাড়ব না।' তিনি আরো বলেন, মামলা করে এবং গ্রেপ্তার করে আমাদের আন্দোলনকে বানচাল করার চেষ্টা চলছে। এটা কেমন বিচার? সরকারের প্রতি অনুরোধ, আমাদের পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়ন করে আমাদের রক্ষা করা হোক।'
পাঁচ দফা দাবি : ইউনিপে মেম্বার্স ক্লাবের পাঁচ দফা দাবি হলো- ১. বাংলাদেশ ব্যাংকের জব্দ করা ইউনিপেটুইউর ৪২১ কোটি টাকা কমিটি গঠন করে গ্রাহকদের মধ্যে ফেরত দেওয়া; ২. গ্রেপ্তারকৃত প্রতারকরা যেন জামিনে বের না হতে পারে- সে ব্যাপারে সরকারের সহায়তা; ৩. পালিয়ে থাকা প্রতারক শাহিন, শাখাওয়াত, তাহের, মিঠু ও চৌধুরীকে ইন্টারপোলের সহায়তায় দেশে ফেরত আনা; ৪. দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলার নিষ্পত্তি করা ও এসবির রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা এবং ৫. থানায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করা।

No comments

Powered by Blogger.