গণহত্যার দলিল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নিজ নিজ ভূমিকা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর কয়েকজন জেনারেল ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। এসব বইয়ের তালিকায় এবার সংযোজিত হলো মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা লিখিত ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-৭১।’


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার দলিল হিসাবে এ বইটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে পাকিস্তানী জেনারেল রচিত এই বইটির প্রকাশনাকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে অনেকে চিহ্নিত করেছেন। এ বইটিতে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতা বিষয়ে বেশ কিছু গোপন তথ্য তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানী বাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা বইটি লেখার পর তাঁর নিজ পরিবারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেবল তাঁর মৃত্যুর পরই যেন তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়। জেনারেলের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার বইটি প্রকাশ করতে উদ্যোগী হয়। গত ৭ জুলাই পাকিস্তানের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস বইটি প্রকাশ করে। বইটি প্রকাশের পরই তা সারা পাকিস্তানে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। এই বইটির প্রতিটি তথ্য যে সঠিক, তার কারণ জেনারেল জীবিত অবস্থায় বইটি প্রকাশ করতে চাননি। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার বিষয়ে পাকিস্তানে সঠিক তথ্য প্রকাশ করা বাস্তবিকই কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে সেই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একজন জেনারেলের পক্ষে জীবিত অবস্থায় এমন একটি বই প্রকাশ করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। এ কারণে জেনারেলের মৃত্যুর পর বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতার বিষয়ে অনেক প্রামাণ্য তথ্য বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে। ইতোপূর্বে জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল রাও ফরমান আলী কিংবা মেজর সিদ্দিক সালেক তাঁদের লেখা বইয়ে পাক বাহিনীর গণহত্যার বিষয়ে অনেক তথ্য গোপন করেছেন; তাঁরা মূলত নিজেদের সাফাই গেয়েছেন তাঁদের বইয়ে। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে; দীর্ঘকাল পর একাত্তরে পাক বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যার বিষয়ে সত্য প্রকাশিত হয়েছে। একাত্তরের বর্তরতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এক পাকি জেনারেল সেই তথ্য তুলে ধরেছেন।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা তার বইয়ে সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রকাশ্যে ঢাকায় ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন জেনারেল টিক্কা খান। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঙালী নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন লে. জেনারেল নিয়াজী। শুধু তাই নয়, হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে অনেক গোপন ও মূল্যবান তথ্য রয়েছে এ বইটিতে। বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল জেনারেল খাদিম হুসেন রাজার এ বইটি। বইটি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ইতোমেধ্য পাক সেনাবাহিনী বইটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত যত শীঘ্র সম্ভব বইটি সংগ্রহ করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে তা ব্যবহার করা। একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর ‘গণহত্যার দলিল’ হিসাবে বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

No comments

Powered by Blogger.