সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা-দুই প্রশ্নে জেরা শেষ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী আব্বাস উদ্দিন আহমেদ গতকাল সোমবার জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে মাত্র দুটি প্রশ্ন করে তাঁকে জেরা শেষ করে আসামিপক্ষ।


বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আব্বাস উদ্দিন জবানবন্দিতে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিবরণ দেন। তবে ওই ঘটনায় আসামি সাকা চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, সে বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি কিছু বলেননি। তিনি রাউজানের একটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।
আসামির কাঠগড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা জবানবন্দি দেন আব্বাস উদ্দিন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সে সময় তিনি রাউজানের ঊনসত্তরপাড়া গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। গ্রামটি ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। গ্রামের মুরব্বিদের সঙ্গে মিলে তিনি চাঁদা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খিচুড়ি রান্না করে চট্টগ্রাম শহরে পাঠাতেন। ঊনসত্তরপাড়ায় একটি বটগাছের কাছে তাঁরা ব্যারিকেড দিয়ে চেকপোস্ট বসান। ওই রাস্তায় চলাচলকারী গাড়িগুলোকে চেকপোস্টে তল্লাশি করা হতো। ১১ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী তাঁর ছেলেদের নিয়ে একটি ভক্সওয়াগন গাড়িতে যাওয়ার পথে ওই চেকপোস্ট পড়েন। এতে গাড়ি থেকে নামতে হওয়ায় সাকা চৌধুরীসহ অন্যরা চিৎকার ও রাগারাগি করে চলে যান।
জবানবন্দিতে আব্বাস উদ্দিন একাত্তরের ১৩ এপ্রিল ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যার বিবরণ দেন। জবানবন্দিতে বলা হয়, ওই দিন তিনি ঊনসত্তরপাড়ার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি যেতে দেখেন এবং পরে ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনেন। পরে জানতে পারেন, ঊনসত্তরপাড়ায় অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। পরদিন তিনি দু-একজন বন্ধুসহ সেখানে গিয়ে বন্ধু বাবুল মালীর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। গ্রামের ক্ষিতীশ মহাজনের বাড়িতে বিভিন্ন বয়সের কমপক্ষে ৬০-৭০টি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। সাক্ষী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ওই বাড়িতে দুজন গর্ভবতী মায়ের লাশও পড়ে ছিল, তাঁদের পেটের বাচ্চা অর্ধেক বের হয়ে ছিল। পরে মৃতদেহগুলো তাঁরা মাটি চাপা দেন।
আব্বাসউদ্দিন বলেন, জনৈক পেয়ারু, বার্মা ইউসুফ, মফদুল হোসেন গ্রামের হিন্দুদের ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের নেতা ডাকছে।’ কিন্তু তাঁরা ওই নেতার নাম বলেননি। তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে গাড়িতে তিনি দুজন বেসামরিক লোককে দেখেছেন, কিন্তু দূর থেকে তাদের চিনতে পারেননি। লোকজন বলাবলি করছিল, ১৩ এপ্রিল জগৎমল্লপাড়া, কুণ্ডেশ্বরী প্রভৃতি হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম এ পর্যায়ে সাক্ষীর কাছে জানতে চান, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে রাজাকারদের কেউ ছিলেন কি না? জবাবে সাক্ষী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় লোকজন এ কথা বলাবলি করত যে ওই সব ঘটনার সঙ্গে সাকা চৌধুরী জড়িত, কিন্তু আমি নিজে তাঁকে দেখিনি।’
জবানবন্দি শেষে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আহসানুল হক মত (সাজেশন) দেন, জবানবন্দিতে উল্লেখ করা পরিবারসহ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়িতে করে যাওয়ার ঘটনাটি মিথ্যা। জবাবে আব্বাস উদ্দিন বলেন, এটা সত্য নয়। পরে আহসানুল বলেন, ঊনসত্তরপাড়া, জগৎমল্লপাড়া, কুণ্ডেশ্বরীর ঘটনার সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদেরের নাম শোনার ঘটনা মিথ্যা। সাক্ষী এর জবাবেও বলেন, সত্য নয়।
ট্রাইব্যুনাল ২৩ জুলাই এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন: একই ট্রাইব্যুনালে গতকাল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ ও কৌঁসুলি আলতাফ উদ্দিন আহমেদ। এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২২ জুলাই দিন ধার্য রয়েছে। সূচনা বক্তব্যে রাষ্ট্রপক্ষ বলে, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে গঠিত আলবদরের প্রধান ছিলেন নিজামী। তাঁর উৎসাহে ও প্ররোচনায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গঠিত হয়েছে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে সারা দেশে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এসব বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায় ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে নিজামীর ওপর বর্তায়।

No comments

Powered by Blogger.