রুক্ষ শহরে নদীর সি্নগ্ধ পরশ by রানা আব্বাস

নাগরিক ব্যস্ততায় জীবনটা যখন হাঁপিয়ে ওঠে তখন ছুটে যেতে ইচ্ছা করে নদীর পাড়ে! সেই নদী_ যে নদীর পাড়ে কেটেছে দুরন্ত শৈশব। যে নদীকে মনে হয় কিশোরীর আয়না। যে নদীর জলে উপুড় হয়ে দেখা যায় নীল-সাদা আকাশ। যে নদীর স্বচ্ছ জলধারা তিরতির করে কাঁপে মৃদু বাতাসে ।


কিন্তু চাইলেই তো আর ছুটে যাওয়া যায় না সে নদীর কাছে। যাপিত জীবন যেতে দেবে না প্রিয় নদীর কাছে। এমনটা ভাবতেই হয়তো দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়বে আর বাড়তে থাকবে নদীর কাছে ছুটে যাওয়ার ব্যাকুলতা।
প্রিয় নদীর কাছে ছুটে যেতে না পারলেও মানসপটে চিত্রিত সেই নদী দেখার দারুণ এক সুযোগ পাওয়া যাবে ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রকে। সপ্তাহব্যাপী আয়োজিত এ চিত্রপ্রদর্শনীতে দেখা যাবে অনন্ত যৌবনা নদীর সি্নগ্ধ রূপ। মূলত এসব চিত্রকর্মে নদীপাড়ের অসাধারণ সব দৃশ্য তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তিন প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চিত্রকর্মগুলো দেখলে সি্নগ্ধ নদী মূর্ত হয়ে উঠবে মুহূর্তেই, যা ধূসর রুক্ষ এ নগরীতে মেলা বড় ভার।
শিল্পী রফিকুন নবীর চিত্রকর্ম চিরায়ত নদী পাড়ের ঘাটের দৃশ্য তুলে ধরে। যেখানে পারাপারের উদ্দেশে জটলা পাকিয়ে অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মানুষ। হামিদুজ্জামান খানের ছবির আকাশে আঁধার জমে আছে। কিন্তু নদীর বুকে নৌকায় দাঁড় বাওয়া মানুষগুলোর চারপাশে আলোর আভা! আঁধার-আলোর মিশেলে চিরায়ত নদীপাড়ের জীবনটাই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিল্পীর চিত্রকর্মে। শহীদ কবিরের ছবিতে দেখা যাবে নদীর ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি সেতুকে। শিল্পী হয়তো ইতিবাচক অর্থেই এ সেতুকে দেখিয়েছেন। শিল্পী অলকেশ ঘোষের চিত্রকর্মটি দেখামাত্র এ ইট-পাথরের জঙ্গল থেকে নীল জলের বুকে পালতোলা নৌকায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কামালউদ্দিনের ছবিতে দেখা যাবে জাহাজ, কার্গো, লঞ্চ নোঙর করা কোনো এক ব্যস্ত নদীবন্দর। প্রতিটি ছবিই কোনো না কোনোভাবে নদীকে ছুঁয়েছে, ছুঁয়েছে নদীর অবারিত রূপকে।
এ চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজনের নেপথ্যের গল্প শোনালেন গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান। তিনি জানান, গত ২২ ও ২৩ জুন শীতলক্ষ্যায় নৌভ্রমণ করেন তিন প্রজন্মের ২৫ জন চিত্রশিল্পী। আড্ডা-আলাপচারিতা আর নদী সৌন্দর্য অবলোকনের মাধ্যমে দু'দিন কাটান শিল্পীরা। সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে বেশকিছু ছবি আঁকেন শিল্পীরা। সেসব ছবি নিয়ে গত ১৩ জুলাই থেকে গ্যালারি চিত্রকে শুরু হয়েছে 'আড্ডা থ্রু আর্ট' শিরোনামের এ প্রদর্শনী। যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে আমেরিকান সেন্টার ও গ্যালারি চিত্রক।
মূলত শীতলক্ষ্যায় নৌভ্রমণ করে এ চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজন করা হলেও এ প্রদর্শনীর কোনো চিত্রকর্মেই শীতলক্ষ্যার দূষণের চিত্রটি আসেনি। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিলেন শিল্পী মনিরুজ্জামান। আসলে আমরা ইচ্ছা করেই দূষণের প্রসঙ্গটি তুলে ধরিনি। আমরা চেয়েছি ইতিবাচকভাবেই আমাদের নদীকে তুলে ধরতে, নদীর অপরূপ সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে। আর আমরা কিন্তু ইচ্ছা করলেই দূষণ রোধ করতে পারি। ছবির মতোই সুন্দর করে তুলতে পারি আমাদের প্রিয় নদীকে।
২৫ শিল্পীর ২৫ শিল্পকর্ম নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রদর্শনী। প্রতিদিন প্রদর্শনী চলছে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত। প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলেন : রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম. হামিদুজ্জামান খান, শহীদ কবির, বীরেন সোম, অলকেশ ঘোষ, গোলাম ফারুক, মনিরুজ্জামান, লাইলা শারমিন, জহির উদ্দিন, আনিসুজ্জামান, ফিরোজ মাহমুদ, জয়া শাহরিন হক, খালেদ মাহমুদ, সুমন আহমেদ, মোহাম্মাদ ওয়াহিদুজ্জামান, আয়েশা সুলতান, মনজুরুল লভি, জাফরিন গুলশান, মোহাম্মদ ফখরুল, কামালউদ্দিন, রুহুল আমিন তারেক, সাবরিন রাহমান প্রমুখ।
দর্শনার্থী শাম্মা জামান যারপরনাই মুগ্ধ এ প্রদর্শনী দেখে। তিনি জানান, ছবিগুলো দেখলে মনে হয় মুভিং আর্টস, স্থিরচিত্র নয়। মনে হয় হঠাৎ করেই নদীর পাড়ে চলে এসেছি! নাগরিক জীবনের কোলাহল ঠেলে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে একদণ্ড প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে ঢুঁ মারতে পারেন গ্যালারি চিত্রকে। এ প্রদর্শনী শেষ হবে ২০ জুলাই।
rana_geographer@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.