নিষ্ঠুরভাবে ন্যাশনাল পার্কের শতবর্ষী গর্জনগাছ নিধন by আব্দুল কুদ্দুস

কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া গ্রাম। এই গ্রামে প্রায় এক হাজার একর বনভূমি নিয়ে তৈরি বন বিভাগের সংরক্ষিত ‘ন্যাশনাল পার্ক’। যেখানে সারি সারিভাবে দাঁড়িয়ে আছে ৪০ হাজারের বেশি গর্জনগাছ।


নিষ্ঠুরভাবে এই বনের শতবর্ষী গর্জনগাছগুলো কেটে পাচার করা হচ্ছে প্রতিদিন।
স্থানীয় লোকজন জানান, বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে বনের ভেতরে ঢুকে মা গর্জনগাছগুলো কেটে নিচ্ছে। আকাশছোঁয়া বিশাল আকৃতির প্রতিটি গর্জনগাছ বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার লাখ টাকায়। প্রতি ঘনফুট গর্জনগাছ বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকায়। একটি গাছে ৩০০ থেকে ৪০০ ঘনফুট কাঠ পাওয়া যায়।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় কক্সবাজারের একদল সাংবাদিক ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করে দেখেন, প্রকাশ্যে কতিপয় লোকজন শতবর্ষী গর্জনগাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গাছ কাটার চিত্র ধারণ করতে গেলে লোকজন বনে আত্মগোপন করে। বিকেল পর্যন্ত ন্যাশনাল পার্কের গর্জনতলী, মধ্যম মেধাকচ্ছপিয়া, ডুলাহাজারা ও মালুমঘাট এলাকা পরিদর্শন করে শতাধিক গর্জনগাছের গোড়ালিতে কুড়াল দিয়ে কাটার চিহ্ন দেখা গেছে।
মধ্যম মেধাকচ্ছপিয়া গ্রামের লবণচাষি ইউসুফ জালাল (৪৫) ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল সোমবার সকালের দিকেও তাঁরা চার-পাঁচটি গর্জনগাছের গোড়ালি কেটে ফেলতে দেখেছেন। কিন্তু সাংবাদিক দল আসার খবরে তারা পালিয়ে যায়। গাছচোরদের সঙ্গে বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তারাও যোগাযোগ রাখেন।
গর্জনতলী গ্রামের বৃদ্ধা বেগম জান (৮৩) বলেন, ‘জন্মের পর থেকে এই বড় বড় গর্জনগাছ দেখে আসছি। অথচ বনকর্মীরা টাকা নিয়ে এই গাছ কাটার সুযোগ দিচ্ছে।’ গর্জনতলীতে বন পাহারারত অবস্থায় পাওয়া বনপ্রহরী তপন কুমার দে বলেন, ‘চারজন প্রহরী নিয়ে এক হাজার একরের বিশাল গর্জন বন (ন্যাশনাল পার্ক) পাহারা দিতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা চোখের সামনে গাছ কাটলেও কিছু বলতে পারি না। গাছচোরদের হাতে আমরা অসহায়।’
ন্যাশনাল পার্কের তত্ত্বাবধায়ক ও স্থানীয় মেধাকচ্ছপিয়া বনবিটের বিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, তিনি গত ২৬ জুন এখানে যোগদান করেছেন। এরপর তিনি পার্ক ঘুরে ৭০টির মতো গর্জনগাছের গোড়ালি কুড়াল দিয়ে কাটা অবস্থায় পেয়েছেন। এখন যেকোনো মুহূর্তে এসব গাছ হেলে পড়তে পারে।
গাছচোরদের বিরুদ্ধে মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে বিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, শতাধিক সন্ত্রাসী রাতের বেলায় গর্জনগাছ কাটতে আসে। তাই তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় মনিরুল হক, মোর্শেদ আলম, রহমত, জাহেদুল, মামুন ও বালি বাহিনীর দুই শতাধিক সদস্য বিশাল গর্জন বনে ঢুকে মা-গাছগুলো কেটে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশাল গর্জনগাছের গোড়ায় ছিদ্র করে লবণ ও বিষাক্ত তুঁত ঢুকিয়ে দেয়। এরপর গাছটি মরে যায়। পরে গাছটি গোড়া থেকে কেটে পাচার করা হয়।
গতকাল সরেজমিন ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে এসে কক্সবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, নির্জন এই ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মা গর্জন গাছগুলো কেটে ফেলার মহোৎসব চলছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, ১৫০ থেকে ২০০ বছরের পুরোনো এই গর্জনগাছগুলোর গোড়ায় কুড়াল দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে কাটার দৃশ্য দেখলে চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ে। অথচ বন কর্মকর্তারাই এই গাছ কাটার বিপরীতে চোরদের ইন্ধন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এর সুষ্ঠু তদন্ত দরকার। কক্সবাজার বন বিভাগের (উত্তর) বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) খালেক খান বলেন, ন্যাশনাল পার্কে যেসব গর্জনগাছ কাটা দেখা গেছে, এগুলো দুই বছর আগে কাটা। গতকাল যে গাছটি লোকজনকে কাটতে দেখেছেন, সেটিও কয়েক দিন আগে ঝরে পড়া গাছ।
গাছচোরদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না কেন জানতে চাইলে ডিএফও বলেন, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে গাছচোরদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
পার্কে বর্তমানে কত গাছ আছে, জানতে চাইলে খালেক খান বলেন, ‘বলতে পারছি না।’ এর কারণ জানতে চাইলে ডিএফও বলেন, বহু আগে একবার এই পার্কের গাছ গণনা করা হয়েছিল। তখন কত গাছ ছিল জানতে চাইলে বলেন, ‘এই হিসাব আমার জানা নেই।’

No comments

Powered by Blogger.