বিদ্যুতের পাইকারি দাম ২২ শতাংশ বৃদ্ধির সুপা

বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য (বাল্ক) প্রতি ইউনিটে ৮৮ পয়সা বা ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ৫০ ভাগ বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি এ মতামত দিয়েছে। সোমবার দাম বৃদ্ধির ওপর বিইআরসি গণশুনানি করেছে।
শুনানি শেষে জানানো হয়, গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব শুনানি করে সমন্বিত মূল্য বৃদ্ধির রায় ঘোষণা করা হবে।
বিইআরসি’র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কর্তৃক পিডিবিকে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের বিষয় বিবেচনা করে পাইকারি মূল্য ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে ইউনিট প্রতি ৮৮ পয়সা দাম বৃদ্ধি পাবে। দাম বৃদ্ধিতে কমিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সুপারিশ প্রতিফলিত হলে বিতরণ কোম্পানির জন্য বিদ্যুতের মূল্যহার চার টাকা ০২ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চার টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়াবে। গত ৬ জুন কমিশনের কাছে পিডিবির বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়, পহেলা জুলাই থেকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। শতকার ৫০ ভাগ অর্থাৎ দুই টাকা ০১ পয়সা বৃদ্ধি করে বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৩ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।
শুনানিতে মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব তুলে ধরেন পিডিবির পরিচালক (সিস্টেম প্লানিং) মিজানুর রহমান। এখন ইউনিটপ্রতি গড় সরবরাহ ব্যয় ও ট্যারিফ ব্যবধান দুই টাকা ৮৫ পয়সা। দুই টাকা এক পয়সা বৃদ্ধি করা হলেও ৮৪ পয়সা ক্ষতি হবে প্রতি ইউনিটে। দাম বৃদ্ধি করা না হলে চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ হবে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এ ঘাটতির পরিমাণও আনুপাতিক হারে বাড়বে। প্রস্তাবনায় জ্বালানি ব্যয় বাড়লে তাৎক্ষণিকভাবে পাইকারি মূল্য সমন্বয়ের জন্য ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেছে পিডিবি।
অন্যদিকে কমিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে গত অর্থবছরে জ্বালানি তেলে কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত বরাদ্দের চেয়ে ২৪৪ কোটি ২৬ লাখ ৭ হাজার টাকা কম ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। বিইআরসি’র
প্রতিবেদনে পিডিবিকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। উল্লেখিত তিনটি বিষয় হচ্ছে বিদ্যুত রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ দ্রুত ব্যবহারের লক্ষ্যে কমিশন অনুমোদিত রেগুলেটরি গাইডলাইন অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, ২৫ বছরের অধিক পুরনো গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ব্যয় হ্রাস ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পর্যায়ক্রমে সেগুলোকে কমবাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করতে হবে এবং পিডিবির আর্থিক শৃঙ্খলা অক্ষুণœœ রাখার জন্য আন্তঃবিভাগীয় দেনা-পাওনা পরিশোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া।
পিডিবির প্রস্তাব এবং কমিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে রাখতে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো ৮০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (উৎপাদন ক্ষমতায়) চালানোর প্রয়োজন বলে মনে করছে পিডিবি। আর ৮০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতায় চালাতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিটে দাঁড়াবে ছয় টাকা ৮৭ পয়সা। তবে কোন কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে কমিশনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মার্চে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেলে যথাক্রমে ৬০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর ধরে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে পিডিবি এর চেয়ে অনেক কম প্লান্ট ফ্যাক্টরে বিদ্যুত উৎপাদন করেছে। সঙ্গত কারণে গত অর্থবছরের প্রকৃত গড় প্লান্ট ফ্যাক্টরের সঙ্গে ১৫ শতাংশ যোগ করে বিদ্যুতের মূল্য হিসেবে করেছে বিইআরসি।
পিডিবি চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিদ্যুতের সাশ্রয়ী মূল্য নির্ধারণ করতে হলে ৫০ শতাংশ কয়লায় বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে। আর এ কয়লা বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ হতে হবে দেশীয় খনির। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদনও যোগ হতে হবে। গ্যাসের স্বল্পতা এবং তেলের আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে বিকল্প জ্বালানিতে গমন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো ঠিক মতো চালাতে পারলে বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত বলে মনে করেন তিনি।
মূল্য বৃদ্ধির সমালোচনা করে কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, নিরীক্ষিত ও পরীক্ষিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রেভিনিউ রিকোয়ারমেন্ট নির্ধারণ না করে মূল্য ঠিক করার কোন আইনী মানদ- নেই। তাই মূল্য বৃদ্ধির আবেদনটির ওপর অনুষ্ঠিত শুনানি স্থগিত করে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের অনুরোধ করেন তিনি।
বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেন, পিডিবির প্রস্তাব এবং কমিশনের প্রতিবেদনের মধ্যে ফারাক অনেক বেশি। এই কারণে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কারণ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে ভর্তুকির একটি বিষয় জড়িত। ভর্তুকি সরকার দেয়। তারা কি পরিমাণ ভর্তুকি দিতে পারবে তার ওপর নির্ভর করেই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হবে।
শুনানিতে বিআরসি সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, মোঃ ইমদাদুল হক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা প্রতিনিধি ছাড়াও সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত পাইকারি পর্যায়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫ দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি। ২ টাকা ৩৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ২ পয়সা করা হয়েছে। একইভাবে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ বেড়ে ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা ২ পয়সা হয়েছে । সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ পাইকারি ও খুচরা দাম যথাক্রমে প্রতিইউনিট গড়ে ২৮ পয়সা ও ৩১ পয়সা বাড়ানো হয়, যা ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়।

No comments

Powered by Blogger.