স্মরণ-সাহসী সাংবাদিক শামছুর রহমান by ফখরে আলম

১৬ জুলাই ২০০০ রাত ৮টা ২৫ মিনিটে আমার বাসায় ফোন করেন শামছুর রহমানের ছোট ভাই সাজেদ রহমান। ফোনে তিনি বলেন, 'ভাই, আমার ভাইকে গুলি করেছে। আপনি দ্রুত আসেন।' এক মিনিটের মধ্যে মোটরসাইকেলে দড়াটানা মোড় ছাড়িয়ে শামছুর রহমানের অফিসের সামনে এসে পৌঁছাই।


সংবাদপত্র এজেন্ট হাফিজুর রহমান আমাকে দেখেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, 'কাকা নেই। তাঁকে মেরে ফেলেছে।' যশোর জনকণ্ঠ অফিসের সামনেই হাসপাতাল। তাৎক্ষণিক হাসপাতালে পৌঁছে দেখি, জরুরি বিভাগের সামনে আমার প্রিয় বন্ধু জনকণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি শামছুর রহমান শুয়ে আছেন। আমি প্রিয় বন্ধুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরি। উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকি। দেখি তাঁর বুক ফুটো। কপালের পাশে আরেকটি ছিদ্র। মাত্র আধা ঘণ্টা আগে শামছুর রহমানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। ওই দিন শামছুর রহমান ফোনে প্রথমে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি প্রতিদিনের সংবাদ সম্পর্কে জানতে চান। হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে আইনজীবীদের বিরোধ চলছে। এ বিষয় নিয়েও তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি ফোন রাখার আগে বলেন, 'ফখরে আলম, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। পরে বলব।' তিনি তাঁর শেষ কথা আমাকে বলতে পারেননি।
আমি আর শামছুর রহমান এক মোটরসাইকেলে সংবাদ সংগ্রহের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মাঠ-ঘাট চষে বেড়িয়েছি। একপর্যায়ে তিনি আমার পারিবারিক বন্ধুর আসনটি দখল করে নেন। সীমান্তবর্তী শালকোনা গ্রামে শামছুর রহমানের বাড়ি। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবা নিখোঁজ হয়েছেন। বাড়ির বড় ছেলে শামছুর রহমান। যশোর এমএম কলেজে পড়ার সময় আশির দশকে তিনি দৈনিক ঠিকানা পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে দৈনিক বাংলায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। নিজস্ব মেধা, সৃজনশীলতা আর গবেষণাধর্মী লেখালেখির কারণে তিনি ওই পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। পরে তিনি জনকণ্ঠে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি পদে যশোর অফিসে কর্তব্যরত ছিলেন।
শামছুর রহমানকে আজ থেকে ১১ বছর আগে তাঁর অফিসে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। উন্মোচিত হয়নি খুনিদের মুখোশ। জোট, মহাজোট, তত্ত্বাবধায়ক অতীতের তিনটি সরকারই দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক শামছুর রহমানের খুনিদের শাস্তি কার্যকর করার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আমি ২০০১ সালে শামছুর রহমানের প্রিয় পত্রিকা জনকণ্ঠে যোগ দিয়ে শামছুর রহমানের স্মৃতিঘেরা জনকণ্ঠ যশোর অফিসে দুই বছর কাজ করেছি। তাঁর চেয়ার-টেবিলে বসে খবর লিখেছি। আমার পেছনে ছিল জনকণ্ঠের বাঁধানো ফাইল। যার ওপর শামছুর রহমানের রক্ত এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে। আমি সেই রক্তের দাগ দেখেছি। শামছুর রহমান জীবন দিয়ে মৃত্যুকে জয় করেছেন। আমি পরাজিত হয়েছি। স্বেচ্ছায় জনকণ্ঠের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মফস্বলে বসবাস করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিককের মর্যাদা লাভ করতে পারিনি। পারিনি শামছুর রহমানের মতো সর্বধাতুর মাদুলি হতে।

No comments

Powered by Blogger.