জিজ্ঞাসা আজ নিজের কাছেই by হাসান আজিজুল হক

শুধুমাত্র শরীর দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়, এই কবিরাও কিন্তু আমার মতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের সর্বাগ্রগণ্য রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান 'আমার সোনার বাংলা...' আজ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত


রবীন্দ্রনাথের দেড়শত জন্মবার্ষিকীর দিনটি শুধুমাত্র বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের জন্যই নয়, গোটা ভারত এবং এখন খুব সাহসের সঙ্গে বলি, গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্যই সাগ্রহে তাকিয়ে থাকার দিন। হতে পারে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই অপেক্ষা তীব্রতম, পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্যও তা-ই। ভারতের সর্বসাধারণের জন্য হয়তো শুধুই তীব্র আর সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য নানা অনুপাতে উষ্ণ, ঈষদুষ্ণ এবং হতে পারে নিষ্প্রাণ ঠাণ্ডা। আমরা মহাউৎসবের আয়োজন করেছি, করবও। আমাদের আয়োজনটাকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতেও চাইব। আমি অবশ্যই এ মহাউৎসবের মহাউৎসাহের ওপর ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিতে চাইছি না। কিন্তু চৈতন্যের কেশগুচ্ছটা ঠিক মাথার কেন্দ্রে থাকে। তাতে যখন-তখন টান পড়ে। তখন যেসব কঠিন সত্য আমরা মনে করতে চাই না, সেগুলো এসে অযথা উপদ্রব করতে থাকে। এখন আমার মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের কাছে বাংলাদেশের মানুষ দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানের ২৩ বছর বারবার যেতে চেয়েছি, তাতে বাধা পেয়েছি। হিসাব করে দেখি গত শতকের পাঁচের দশকে রবীন্দ্রচর্চার রচিত কোনো নিদর্শনই তেমন নেই। কত লড়াই আর বাঙালি একসঙ্গে করবে! ভাষাটাকেই টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না, রবীন্দ্রনাথকে আহ্বান জানাই কী করে। বঙ্কিমচন্দ্র-মধুসূদনের নাম উল্লেখ করতে গেলে যে পাকিস্তানিদের জিভ খসে পড়ে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকীর কথা মনে করি। আমি তখন উঠতি তরুণ। যেমন প্রচণ্ড জেদ আর সংকল্প ঠিক তেমনি তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবরোধ, প্রতিবন্ধকতা এবং দরকারমতো নির্যাতন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তখন যেতে পেরেছিলাম_ বলতে পারি না। যেতে চেয়েছিলাম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিতে চাই_ বিনা প্রত্যাশায় নয় কিন্তু, তাতে কৃত্য তারাও কঠিন সংকল্প নিয়ে বাস্তবায়ন করবে এই আশায় যে, এটা একটা সংগ্রামই ছিল। রক্তাক্ত সংগ্রাম নয়, যেটা দশকের শেষে এসে রক্তাক্ত সংগ্রামেই রূপ নেবে। একদিকে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ ও চর্চার লড়াই, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত করার উপায় অবলম্বন। বাঙালি মেয়ে শাড়ি পরবে না, কপালে টিপ দেবে না, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে না, দরকার হলে নিজেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখবে_ এই ছিল বর্বর, অশিক্ষিত, সংস্কৃতিহীন স্থূল প্রকৃতির পাকিস্তানি শাসকদের কথা। তরুণ প্রজন্ম মনে রাখুন, আপনাদের মতো তখন যারা তরুণ ছিলেন, তারা এটা মেনে নেননি। অনেক প্রবীণও সঙ্গে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, আমাদের পঞ্চকবির জন্য আলাদা আলাদা সিংহাসন পেতে দেওয়া হয়েছিল। শুকনো তৃণের মতো বাঙালির ফুৎকারে সব বাধা-প্রতিবন্ধক উড়ে গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে নজরুল, জীবনানন্দ, অতুল প্রসাদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন। বলতে চাইছি শুধুমাত্র শরীর দিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়, এই কবিরাও কিন্তু আমার মতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের সর্বাগ্রগণ্য রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান 'আমার সোনার বাংলা...' আজ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। অর্জনটা কি সামান্য? এই অর্জনটাই কি নানা দিকে আমাদের যে সংস্কৃতিসহ সর্বস্ব ধ্বংস করে দিতে চাইছে, চুরমার করে দিতে চাইছে, সত্তা এবং অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করতে চাইছে, এই অর্জনটাই কি আজ রবীন্দ্রনাথের সার্ধ জন্মশতবর্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর ইস্পাতকঠিন সংকল্প নিতে বাধ্য করবে না! নিজেরাই নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করি_ যেতে চেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কাছে, চলি্লশ বছরে হয়তো সত্যিই যাওয়া হয়নি, হয়তো সত্যিই পদে পদে রবীন্দ্রনাথকে লঙ্ঘন করাই হয়েছে। কোথায় সেই রবীন্দ্রনাথের সর্বমানবিক কল্যাণের ধারণা? কোথায় সেই মানুষের আকাশে মাথা তোলা সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সৃজন? কোথায় সেই রাষ্ট্র, কোথায় সেই সমাজ, যেখানে প্রতিটি মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের মেধা ও শ্রমের ফসল নিজেই ভোগ
করবে আর সকলের সঙ্গে মিলেমিশে এক অভ্রভেদী বাংলাদেশ তৈরি করবে। প্রতিটি বাঙালি নিজেকে জিজ্ঞেস করুক এই দিনটিতে সে কি তা করেছে, প্রকৃতপক্ষেই তাঁর চর্চার দিকে এগিয়েছে? না ভুলের দিকে, স্বার্থের দিকে, প্রযুক্তির যান্ত্রিক চকমকানির দিকে সংস্কৃতিতে, শিক্ষায় ঝুঁকে পড়েছে। এই সাহস কি আমাদের হবে_ নিজেদেরকে বলতে যে, রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে চেয়েছিলাম, স্বল্পকালের জন্য গিয়েছিলামও, তারপর সত্যি তাঁর কাছে যাইনি। তাঁর কাছ থেকে নিইনি, তাঁর জন্য নয় আমাদের জন্য। আমরা যেন নিজেকে স্তোকবাক্যে হৈ-হুল্লোড়ে না ভোলাই।

হাসান আজিজুল হক : শিক্ষাবিদ ও কথা সাহিত্যিক
 

No comments

Powered by Blogger.