ওবামার এশিয়া সফর-ওবামা জানেন, এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের দিন শেষ by পঙ্কজ মিশ্র

বারাক ওবামা এখন এশিয়ার চারটি দেশ (ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান) সফরের মধ্যে রয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির বড় কোনো এজেন্ডা তাঁর থাকার কথা। কিছুদিন আগে চীনা মাছধরার নৌকা জাপানিরা আটক করার পর থেকে জাপান ও চীনের সম্পর্কে সুস্পষ্ট অবনতি ঘটেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে শঙ্কিত থাকতে হচ্ছে তার প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক রদবদলের বিষয়ে।
ভারত ও ইন্দোনেশিয়াকে নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সামনে কতগুলো কৌশলগত চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জগুলো বেশ জটিল। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের বিষয়টি (যাকে ওবামা ২০০৮ সালে তাঁর ‘কঠিন কাজ’-এর মধ্যে রেখেছিলেন) যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধের প্রতি পাকিস্তানের অঙ্গীকারকে স্পষ্টত দুর্বল করে। অন্যদিকে, ওবামা ইন্দোনেশিয়ায় সফরের সময়সূচি দুবার বাতিল করে অবশেষে এ সপ্তাহান্তে সেখানে তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিচারণা করার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। তা ছাড়া ২০০৯ সালে কায়রোর পর আবারও তিনি মুসলিম বিশ্বের কাছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন।
অবশ্য ওবামা এবারের সফরের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট কথাতেই তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন নিইউয়র্ক টাইমস-এ তাঁর লেখা এক নিবন্ধে, ‘আমাদের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পণ্যের জন্য নতুন বাজারে নতুন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া।’ গত সপ্তাহে প্রকাশিত এই নিবন্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, আসিয়ানে ইন্দোনেশিয়ার সভাপতিত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার কর্মসৃষ্টির গুরুত্ব নিয়ে কথা থাকলেও এশিয়ায় মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা নিয়ে একটি কথাও নেই।
নিবন্ধটিতে ওবামা যে বার্তা দিয়েছেন, তা থেকে ভারত সফরে তাঁর বিচ্যুতি ঘটেনি। তিনি কথা বলে গেছেন ব্যবসাসংক্রান্ত চুক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসৃষ্টি নিয়েই। মধ্যবর্তী নির্বাচনের ধাক্কা তাঁকে হয়তো কিছুটা সংযত করেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় থাকতে হলে তাঁকে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব থামাতে হবে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গতি সঞ্চার করতে হবে। তা ছাড়া জটিল পররাষ্ট্রনীতির বিষয়াবলি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, এমন ধারণা দূর করার চেষ্টাও হয়তো তিনি করছেন।
ওবামার ভূ-রাজনৈতিক আত্মপ্রত্যয়হীনতা এক অকাট্য সত্যের স্বীকৃতি। সত্যটি হলো, অর্থনৈতিক মন্দা এবং একের পর এক সামরিক-কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফলে দুর্বল হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্র আর এশিয়ার ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নয়। অথচ স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এমন ক্ষমতার প্রয়োগ বারবার করেছে, অনেক ক্ষেত্রে যার প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়াবহ।
এই অবস্থা কেমন করে হলো? চীনের উত্থানের কথাই ঘুরেফিরে বারবার উচ্চারিত হতে দেখা যায়। কিন্তু এতে পুরোটা ধরা পড়ে না। চীনের উত্থানের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এশিয়ার জনগণের রাজনৈতিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক আঞ্চলিকতাবাদের মাধ্যমে এশিয়ার বহু দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা। অথচ এই দেশগুলোই আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব অনুসরণ করেছে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ছায়ার নিচে গুটিসুটি মেরে থেকেছে।
এশিয়ার রঙ্গমঞ্চে এই নাটকীয় পরিবর্তন সম্পর্কে ওবামার চেয়ে বেশি সচেতন কোনো মার্কিন রাজনীতিক হয়তো পাওয়া যাবে না। এশিয়ার সঙ্গে তাঁর সংযোগ দীর্ঘকালের। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে তিনি জাকার্তায় বাস করেছেন, থেকেছেন মাটির ঘরে। ছাত্রাবস্থায় ১৯৮১ সালে পাকিস্তান ও ভারত সফর করেছেন। আর পরিণতি অর্জন করেছেন এমন এক সময়ে, যখন পর্যন্ত প্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন ছিল। বহু মার্কিন কর্মকর্তা-রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী তখনো ‘নতুন এশিয়া’ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন। সে দায়িত্ব ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলোর হাত ধরে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বর্তেছে বলে তাঁরা মনে করতেন।
ছয় বছর বয়সে ওবামা তাঁর মায়ের সঙ্গে জাকার্তায় চলে এলেন। এর দুই বছর আগে সেখানে সামরিক ও আধাসামরিক কতগুলো মুসলিম গোষ্ঠী প্রায় পাঁচ লাখ সন্দেহভাজন কমিউনিস্টকে হত্যা করেছিল, যাতে সিআইএর মদদ ছিল। জেনারেল সুহার্তোর দীর্ঘ শাসনের সময়ে (১৯৬৭-১৯৯৮) ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাচ্চা অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল।
যে ধরনের সামরিক নৃশংসতায় সুহার্তো বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের একান্ত অনুগত পুঁজিবাদী-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার পক্ষে উচ্চমানের বুদ্ধিবৃত্তিক ন্যায্যতার কোনো অভাব হয় না কোনোকালে। ১৯৬৮ সালে স্যামুয়েল হান্টিংটন লেখেন পলিটিক্যাল অর্ডার ইন চ্যাঞ্জিং সোসাইটিজ। এই বইটি দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব দ্য পলিটিক্যাল অর্ডার-এর থেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং অধিকতর ক্ষতিকর হয়েছিল। হান্টিংটনের লেখায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নকে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সুহার্তো থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং-হি এবং ইরানের শাহ পর্যন্ত সব মার্কিনপন্থী স্বৈরশাসক অত্যন্ত যত্নসহকারে হান্টিংটনের তত্ত্বকে নিয়েছিলেন।
বিশৃঙ্খল গণতন্ত্রের চেয়ে প্রবল কমিউনিজমবিরোধীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্বের আরেক সুবিধাভোগী পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক। ১৯৫৪ সালে তুরস্ক ও ইরানের পাশাপাশি পাকিস্তান স্নায়ুযুদ্ধে শরিক হয়ে পড়ে। মহান উর্দু ভাষার সাহিত্যিক সাদত হাসান মান্টো সে বছর আঙ্কেল স্যামকে উদ্দেশ করে একগুচ্ছ ব্যঙ্গাত্মক চিঠি লেখেন। একটি চিঠিতে ছিল, ‘প্রিয় চাচা, আপনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, কেননা রাশিয়ান কমিউনিজমের সবচেয়ে ভালো মহৌষধ আমাদের এই মোল্লা।’ ১৯৮১ সাল নাগাদ জিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে উৎসারিত কমিউনিজমের মোক্ষম জবাব হলো বৈশ্বিক জিহাদ।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিন্যাস জমাট বেঁধেছিল, তার কোনোটাই আর টেকার কথা নয়। আর নিজের মতো করে গলে গেল। তাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপক মাত্রার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, যা ছিল হান্টিংটনেরও কল্পনার বাইরে। গণ-অভ্যুত্থান অবশেষে ক্ষমতাচ্যুত করে সুহার্তোকে। ইন্দোনেশিয়া গণতন্ত্রায়ণের এক ঝঞ্ঝামুখর সময়ের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় বিদায় নেন জেনারেল জিয়া। কিন্তু তিনি যে ধর্মীয়-রাজনৈতিক আবেগ অবারিত করেছিলেন, তা আজও রয়ে গেছে। ওবামা ছাত্রাবস্থায় যখন পাকিস্তানে যান, তখন সেখানকার সামন্তীয় সমাজে যে নিষ্ঠুর অন্যায় দেখেছিলেন, তা থেকে রসদ নিয়ে তা টিকে আছে।
ইন্দোনেশিয়ায় রাজনীতি থেকে হয়তো সামরিক বাহিনীকে দূরে ঠেলে দেওয়া গেছে। কিন্তু পাকিস্তানে এখনো দায়িত্বহীন মার্কিন সাহায্যের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের বাড়বাড়ন্তি। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা তাদের অর্থ জোগান কৌশলকে পরিশীলিত করে শিল্পের রূপ দিয়েছে, যদিও পাকিস্তানের জনমত হয়ে পড়েছে প্রচণ্ড মার্কিনবিরোধী।
এশিয়ার প্রায় প্রতিটি কোনায় আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস। উন্নততর কৌশলের কাছে পরাভূত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর চার দিক থেকে ঘিরে ধরা হচ্ছে। বর্তমান মিত্র (পাকিস্তান, আফগানিস্তান) কিংবা এত দিনকার অনুগ্রহভাজন, সবাই এতে শামিল। শাহের শাসন থেকে রেহাই পাওয়ার কয়েক দশক পরও ইরানের শাসকেরা প্রচণ্ড পশ্চিমাবিরোধী আবেগ কাজে লাগাতে পারে ইরাক, আফগানিস্তান, লেবানন ও গাজায় তাদের পুতুল ও বন্ধু সরকার অধিষ্ঠিত থাকার কারণে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে এ অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধকালীন মার্কিন উপস্থিতি এখন পর্যন্ত জারি রাখার বিরুদ্ধে জনগণের বিরোধিতার প্রতি নজর না দিয়ে পারা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গত তিন দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য মালয়েশিয়া অবিরত ‘পূর্বমুখী’ হয়েছে। ওয়াশিংটন কনসেনসাস মৃত্যু ঘটার বহু আগেই ১৯৯৭-৯৮ সালের পূর্ব এশীয় অর্থনৈতিক সংকট মার্কিন নীতির প্রতি জনগণকে বিরূপ করেছে।
মার্কিন প্রভাব কমে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে ভারতেও। যদিও ভারতের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃত্বের মধ্যে মার্কিন সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি লজ্জাজনক অনুরাগ দেখা যায় (প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং হঠাৎ করে জর্জ বুশকে বলে ফেলেছিলেন, ‘ভারতের জনগণ আপনাকে ভালোবাসে’)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সমর্থন না করে দোহা আলোচনায় ভারত নিজ দেশের কৃষকদের সুরক্ষায় জোরালো অবস্থান নিয়েছিল। উদারভাবে বুশ প্রশাসন পারমাণবিক চুক্তি উপহার দিয়েও ভারতকে মার্কিন বিনিয়োগকারী ও রপ্তানিকারকদের প্রতি অধিকতর অতিথিপরায়ণ করতে পারেনি।
ওবামা বুঝতে পারবেন, মন্দাক্রান্ত পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে এশিয়ার বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিগুলোর মধ্যেই ভারতের আরও অনেক সম্ভাব্য বন্ধু রয়েছে। এই সম্পর্কগুলো ভারতের জন্য অধিকতর লাভজনকও। থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা কাটিয়ে উঠেছে। গত বছর ভারত আসিয়ানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মালয়েশিয়ার প্রধান ইংরেজি দৈনিক স্টার-এ এক কলামিস্ট কুয়ালালামপুরে হিলারি ক্লিনটনের বিলাসভ্রমণের চেয়ে একই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করেছেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
অনেকগুলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি এশিয়ার এই নতুন অর্থনৈতিক ঐক্যের মূলে। ইতিমধ্যে চীন এবং আসিয়ান বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুক্তবাণিজ্য এলাকা গঠন করেছে। চীনের উত্থানে এশিয়ার শঙ্কা তেমন গুরুতর নয়। চীন এখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এবং ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
যেসব টি-পার্টিওয়ালা মনে করে যে বিদেশে যেকোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকট যুক্তরাষ্ট্র বোমা মেরে উতরে যেতে সক্ষম, তাদের সেই ধারণার সঙ্গে এশিয়ার বাস্তবতা মেলে না। ওবামার ওপর দায়িত্ব তাদের শিক্ষিত করে তোলা, তাদের ভুল ভাঙানো। অবশ্য এই অপ্রশংসনীয় কাজে তাঁর ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
পঙ্কজ মিশ্র: ভারতীয় ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.