নজর দিতে হবে সমস্যার গোড়ায়-নারীর প্রতি সহিংসতা

তরুণ-তরুণীদের স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে যে উটকো ও তিক্ত বিষয়টি ঢুকে পড়েছে, তা ‘ইভ টিজিং’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। যাকে ভাবা হয়েছিল সামাজিক ঝঞ্ঝাট, তা সামাজিক বিপর্যয়ে পরিণত হওয়ায় টনক নড়েছে অনেকেরই। নারীর বিরুদ্ধে সহিংস যৌন-উৎপাতকে ‘ইভ টিজিং’ নামের কোমল শব্দ দিয়ে এর গুরুত্ব ও অপরাধের ব্যাপকতা ঠিক বোঝানো যায় না।


কেননা, এ শব্দে উদগ্র ব্যাটাগিরির ওপর জোর না দিয়ে বরং আক্রান্ত নারী বা ‘ইভ’কেই নিশানা করা হয়। শব্দ বদলের পাশাপাশি সমস্যার প্রতিকারে আরও গভীর ও ব্যাপক আয়োজনের প্রয়োজনের কথাই উঠে এসেছে বুধবার প্রথম আলোর ‘উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ’বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে।
গোলটেবিলে শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে নারী অধিকার সংগঠক, আইনবিশারদ, পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদসহ এ বিষয়ে জড়িত বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। তাঁদের আলোচনায় উত্ত্যক্ত তথা যৌন-উৎপাতের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করা হয়। বক্তারা একমত হন, কঠোর আইনের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না, প্রতিষ্ঠা করা যাবে না নারীর মর্যাদা।
আইন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে নারীবান্ধব করার কথা আসে। পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শৈশবেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধের বীজ বুনে দেওয়ার কথাও আসে। যেসব যুবক আজ সামাজিক শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে; তাদের সংশোধন, শাস্তি ও বোধোদয়ের লক্ষ্যে কাজ করার কথাও বলা হয়। বলা হয় একটি মানবিক, অগ্রসর ও সহনশীল সংস্কৃতি নির্মাণের কথা। ছেলেশিশুদের শৈশবেই যথাযথ নৈতিক শিক্ষা দেওয়া গেলে তাদের অনেকেই বখে যেত না এমন কথাও আসে।
এসব আলোচনা থেকে একটি জিনিসই উঠে আসে, নারীর বিরুদ্ধে যৌন-সহিংসতা আমাদের সার্বিক সহিংস সামাজিক পরিস্থিতিরই অংশ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নারী-পুরুষের বৈষম্যেরই ফল নারীর নিরাপত্তাহীনতা। যৌন হয়রানি, নিপীড়ন বা ইভ টিজিং যা-ই বলি, এটা এমন এক মেয়াদি বোমা, যার শেকড় অতীতের উদাসীনতায় কিন্তু এর কুফলের চরম রূপ দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি। তাই আশু প্রতিকার হিসেবে সরকারের কঠোরতার পাশাপাশি স্থায়ী সমাধান হিসেবে সমস্যার মূলে হাত দেওয়াও প্রয়োজন। এমন পরিবার, এমন সমাজ, আর এমন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে, যেখানে ছেলেরা মেয়েদেরও সমমর্যাদার মানুষ হিসেবে দেখবে। এবং অবশ্যই মেয়েরা বৈরী বাস্তবতায় হতাশ হবে না, বা অন্যের দোষে নিজে গ্লানিতে ভুগে আত্মহত্যা করবে না। সে রকম এক মানবসমাজ বিনির্মাণই পারে যৌন হয়রানির বর্বর বাস্তবতার উত্তরণ ঘটাতে।

No comments

Powered by Blogger.