বিশেষ সাক্ষাৎকার-ক্ষতিপূরণ আদায়ে নতুন আইনি কাঠামো প্রয়োজন by রিচার্ড লর্ড

সম্প্রতি ঢাকায় অক্সফাম আয়োজিত প্রতীকী জলবায়ু আদালতে পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের আইনজীবী রিচার্ড লর্ড। আন্তর্জাতিক পরিসরে দ্বন্দ্ব মীমাংসাকারী বা আর্বিট্রেটর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনার পর তিনি সামুদ্রিক যানের ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে কাজ করেছেন।


জাহাজ কোম্পানিগুলোর হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হয়ে পরিবেশগত ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি।
২০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে আইন পেশায় যুক্ত এই আইনজীবী স্টোই স্কুল এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিডনি সাসেক্স কলেজ থেকে আইন পেশায় স্নাতকোত্তর ও ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন। গাইড টু আর্বিট্রেশন, বিলস অব লেডিং, কন্ট্রোল ড্রাগস ল অ্যান্ড প্র্যাকটিসসহ আইন বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো  আন্তর্জাতিক পরিসরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে। ক্ষতিপূরণ আদায় কীভাবে সম্ভব?
রিচার্ড লর্ড  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সোচ্চার হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে তারা ক্ষতিপূরণের বিষয়টি তুলছে। এটি মানবিক আবেদনের বিষয়। তবে একজন আইনজীবী হিসেবে শুরুতেই আমি দেখব, এ বিষয়ে কী ধরনের প্রমাণ ও আইন আছে। কোন দেশ কী পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে এবং কোন দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে। কোনো দেশ যদি মনে করে, তার ওপর অবিচার হচ্ছে, তাহলে তারা ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলতে পারে। তবে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো আইনি কাঠামো এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
প্রথম আলো  তাহলে কি আপাতত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো সুযোগ নেই?
রিচার্ড লর্ড  একদম সুযোগ নেই, তা বলা যাবে না। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ঘোষণা ও চুক্তিতে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগ আছে। ইউএনএফসিসি ও আইপিসিসির মতো কাঠামো তৈরি হয়েছে। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণকে দায়ী করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ আছে, অভিবাসন বিষয়ে আইন আছে। আরও বেশ কিছু আইনের মধ্যে দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রয়েছে। বিদ্যমান এসব আইন, চুক্তি ও সনদকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে।
প্রথম আলো  জাতিসংঘের আওতায় কিয়োটো প্রটোকল চুক্তি, কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড (রাজনৈতিক অঙ্গীকার), বালি অ্যাকশন প্ল্যানসহ নানা কাঠামো এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। এগুলো কি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট?
রিচার্ড লর্ড  কিয়োটো প্রটোকল চুক্তিতে বিশ্বের সব দেশ স্বাক্ষর করলেও যুক্তরাষ্ট্র এটি অনুমোদন করেনি। কোপেনহেগেন অ্যাকর্ডের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক মতৈক্যের দলিল। জাতিসংঘে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবেশ আদালত প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অ্যাটমোস্ফেরিক ট্রাস্ট লিটিগেশন আইনটি ‘এখনো শিশু’ হলেও এর কারণে প্রাচীন বেশ কিছু মৌল নীতির প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে।
বিদ্যমান আইন ও চুক্তিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, তার আইনি সুরক্ষার জন্য নতুন ধরনের অনেকগুলো উপায় (অ্যাপ্রোচ) অবলম্বন করতে হবে। স্বতন্ত্র আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে।
প্রথম আলো  এই আইনি কাঠামো তৈরির জন্য বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কী করতে পারে?
রিচার্ড লর্ড  প্রথমত, জনগণের নানা উদ্যোগ ও চাপ বাড়াতে হবে। ক্ষতির বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো জাদুকরি সমাধান নেই। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের মতো দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মামলা করতে পারে।
আদালতে বিচারক বলবেন, কে ক্ষতিগ্রস্ত আর কে দায়ী? দুই পক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে। উন্নত দেশগুলো এ ক্ষেত্রে বলতে পারে, তোমরা যে পদ্ধতিতে উন্নয়নের জন্য বর্তমানে এগোচ্ছ, আমরা তো একই উপায়ে এগিয়েছি। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য আর আদালতে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ক্ষতি প্রমাণ করা—এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
প্রথম আলো  বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নিতে হবে?
রিচার্ড লর্ড  কোন আইনে এবং কী ধরনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ চাইবে, তার ওপর প্রস্তুতির বিষয়টি নির্ভর করবে। শুরুতেই আমি বলব, কোথায় কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখতে হবে। তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে দুর্যোগগুলো হচ্ছে এবং এর ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা প্রমাণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দুর্যোগের পরপরই সমীক্ষা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী, তথ্য সংগ্রহকারী ও আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
প্রথম আলো  জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতি স্বীকার করলেও উন্নত দেশগুলো এর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে এখনো উদাসীন। তারা দায় স্বীকার করলেও দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। নানা আইনি মারপ্যাঁচে জলবায়ু তহবিলের বিষয়টিও সক্রিয় হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশ কীভাবে এগোতে পারে?
রিচার্ড লর্ড  যারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করছে, তাদের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। পেশাদার আইনজীবীদের সঙ্গে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ক্ষতিপূরণের দাবি তোলাটা রাজনৈতিক হলেও ক্ষতিপূরণ আদায়টা অনেক পেশাদারির সঙ্গে করতে হবে।
প্রথম আলো  আপনি তো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটরিনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পক্ষ হয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছেন। বাংলাদেশে সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা কীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে?
রিচার্ড লর্ড  যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্যাটরিনা আঘাত হেনেছিল যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানায়। সেখানকার মানুষ বিমা-ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেশির ভাগ সম্পদ বিমা করা থাকে। বিমার অর্থ আদায়ের জন্য কী ধরনের তথ্য ও নথি সংগ্রহে রাখতে হয়, তা সেখানকার মানুষ জানে। ফলে বিমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অর্থ আদায় করা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামীণ পর্যায়ে বিমা-ব্যবস্থা এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়নি। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে ক্ষতিগুলো হচ্ছে, তা সঠিকভাবে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করতে পারে।
প্রথম আলো  কিন্তু বাংলাদেশ তো আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। জাতিসংঘ বলছে, এর জন্য দায়ী উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ। বাংলাদেশ সরকার, কোম্পানি বা কোনো ব্যক্তি সে ক্ষেত্রে কীভাবে তা ধনী দেশগুলোর কাছে তুলতে পারে?
রিচার্ড লর্ড  এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক পরিসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য কোনো যথার্থ ফোরাম নেই। অক্সফাম বাংলাদেশে যে প্রতীকী জলবায়ু আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে, তা বাস্তবে রূপ দিতে হবে। জাতিসংঘের আওতায় একটি আন্তর্জাতিক জলবায়ু আদালত প্রতিষ্ঠান করতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার, অভিবাসন, নারী ও শিশু অধিকারসহ যেসব আইনি কাঠামো রয়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।
জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্পষ্টত দায়ী করা হয়েছে। ধনী দেশগুলোর বড় বড় কোম্পানি যেমন: এক্সন, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) ও বিভিন্ন কয়লানির্ভর জ্বালানি সরবরাহকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্যোগ ও এর ক্ষয়ক্ষতিগুলোকে যথার্থভাবে নথিভুক্ত কররে পারলে এই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে।
প্রথম আলো  বিশ্বের কোথাও কি এ ধরনের মামলা হয়েছে?
রিচার্ড লর্ড  বাংলাদেশ প্রতীকী জলবায়ু আদালতের আগে ২০০৯ সালের ব্যাংককে এ ধরনের একটি আদালত বসেছিল। ফিলিপাইনে এমজি মেথন ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা করেছিলেন। এক্সন, বিপিসহ বিশ্বের ৩০টি কোম্পানিকে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম দায়ী হিসেবে উল্লেখ করেছিল। বলা হয়েছিল, এই কোম্পানিগুলোর কার্বন নিঃসরণের জন্য পৃথিবীর বরফখণ্ড গলে যাচ্ছে। বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে।
প্রতিটি বহুজাতিক কোম্পানির বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে শাখা রয়েছে। তাদের দায়ী করে কোম্পানিগুলোর হোম কান্ট্রির আদালতে মামলা করা যায়। বহুজাতিক কোম্পানির দূষণের কারণে রোগ ছড়িয়ে পড়ায় সম্প্রতি পেরু বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিপিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। তবে এ বিষয়গুলো পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে হচ্ছে। জলবায়ু ক্ষতিপূরণের বিষয়টির জন্য হচ্ছে না।
প্রথম আলো  বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কি এর দায় স্বীকার করবে?
রিচার্ড লর্ড  যথার্থ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এগুলো তাদেরকে দায় স্বীকার করতে বাধ্য করা যাবে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসগুলো কোম্পানিগুলোকে আগে থেকে জানাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলো সম্পদের মালিকের কাছ থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কেও ধারণা নেয়। তবে জাতিসংঘের আওতায় একটি আইনি কাঠামো তৈরি না হলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা কঠিন।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
রিচার্ড লর্ড  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.