রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী-পরতে পরতে তাহার পরশ by আতিকুল হক চৌধুরী

রবীন্দ্রনাথ শুধু গল্পে নয়, কবিতায় নয়, গানে নয়, উপন্যাসে নয়, নাটকে নয়, চিঠিতে নয়, প্রবন্ধ বা ছবিতেও নয়। রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ শুধু জীবন ও প্রকৃতির বর্ণনাকারী কবিই নন, তিনি জীবন ও প্রকৃতির পরিচয় উন্মোচনকারী কবি। রবীন্দ্রনাথের প্রেম উত্তেজনা আর উন্মাদনার প্রেম নয়।


দেহের অস্তিত্ব স্বীকার করেও তা এক দেহাতীত প্রেম


আট অক্ষরের একটি নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেক চেনা নামের মাঝে অতিচেনা একটি নাম। অনেক পরিচিত মুখের মাঝে অতিপরিচিত একটি মুখের ছবি। রবীন্দ্রনাথের ছবি। এই নামটি ও এই ছবির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই ১৯৩৭ সালে। বাখেরগঞ্জে জীবন সিংহ হাইস্কুলে। আমি তখন ক্লাস থ্রির ছাত্র। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাকে আবৃত্তি করতে হবে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ।' আমাকে ক্লাসের একজন শিক্ষক অনেকদিন ধরে এই কবিতাটি আবৃত্তি করাতে, যাকে বলে উঠেপড়ে লেগেছিলেন।
স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। জানাতে ভালো লাগছে, ওই অনুষ্ঠানে যেমন পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম, তেমনি পেয়েছিলাম 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ' কবিতাটি আবৃত্তি করেও। প্রাইজ পেয়েছি। অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বই। লাল ফিতায় বাঁধা। কঠিন কথা রবীন্দ্রনাথ অনেক সহজভাবে বলতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে, তার যে কোনো লেখা পড়লেই ভেসে আসে অনেক ছবি। চোখ মেলে দেখতে পারি। স্বপ্নও বানাতে পারি। আমার মনের ময়ূর রাবীন্দ্রিক মেঘ দেখলে, রাবীন্দ্রিক বৃষ্টি হলে উথলা হয়ে খুশির পাখনা মেলে নাচতে থাকে। আমার তৃতীয় নয়ন খুলে যায়। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এ জগৎ থেকে অন্য এক জগতে। সীমা থেকে অসীমের পানে। কোনো এক অদেখা জগৎ যেন আমাকে 'আয় আয়' বলে হাতছানি দিয়ে ডাকে বারবার। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচার ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন মুগ্ধ শ্রোতা।
ছোটবেলা আম্মার মুখে রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসগুলো যখন বড় হয়ে আবার পড়েছি তখন মনে হয়েছে, এ গল্প ও এ উপন্যাস আমার যেন অনেক দিনের চেনা। কিন্তু জীবনের সব চেনা বিষয় কি জানা হয়ে ওঠে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাস পড়ে বিভিন্ন চরিত্র ও বিষয়গুলো সম্পর্কে মনে যে ভাবনার উদ্রেক করেছে সে ভাবনাই পরবর্তী পর্যায়ে রবীন্দ্র জীবন দর্শনকে জানতে, চিনতে, উপলব্ধি করতে বোধকরি আমাকে সাহায্য করে অনেক। রবীন্দ্রনাথের রচনায় দৈনন্দিন জীবনের গ্গ্নানি আছে, বিরোধ আছে, আছে এক ধরনের রোমান্টিক বিন্যাস। রবীন্দ্রনাথের রচনায় বাস্তবতার একটি বিশেষ গভীর পরিচিতি আছে ও শিল্পসম্মত পরিণতি আছে। নৌকাডুবি বা গোরার কথা যদি বলি তবে বলতে হয়, স্বাভাবিক আশার চোখে রবীন্দ্রনাথ আশার অন্তর্মুখী ফলের বিশ্লেষণের ওপরই জোর দিয়েছেন বেশি। গোরার সুচরিতা, শেষের কবিতার লাবণ্য ও যোগাযোগের কুমুদিনী প্রেমে কমল-সমাহিত আবার অন্যদিকে চেতনাসম্পন্ন দৃঢ় অবিচল। তাদের সৌরভ আছে আবার গৌরবও আছে। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাসটি নাট্যরূপ দিয়ে তা টিভিতে প্রযোজনা করার সুযোগ হয়েছিল আমার। চোখের বালিতে মহেন্দ্র, বিনোদিনী বিহারী ও আশা_ সবাই মিলে যেন একটা নাটকীয় ঘূর্ণাবৃত্তের সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকের চরিত্রেই আলাদা গতিবেগ আছে। ঘরে বাইরে উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে প্রযোজনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। নিখিলেশ বিমলাকে পেতে চেয়েছে তার ঘরের সুরক্ষিত দুর্গের মধ্যে। কিন্তু বিমলা তাতে সুখী হতে পারেনি বলেই সন্দীপের বাহুবন্ধনে ধরা দিতে চেয়েছে বারবার। নিখিল জড়। কিছুটা শিথিল। সন্দীপ আবেগময়। নিখিল দুর্বল। সন্দীপ দুর্জয়। তবু তো বিমলা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে পারেনি সন্দীপের কাছে। অমূল্যের মধ্যে একটি পুরনোর সুর যেন ভ্রাতৃস্নেহে ভর করে নতুন জীবনের একটি মমতার বাণী নিয়ে এসেছিল বিমলা কাছে। সেই মমতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়েই বিমলা আবার যেন বাইরে থেকে ঘরে ফিরে যেতে চেয়েছে। নিখিলেশ ও সন্দীপের দুই বিপরীতমুখী আকর্ষণের মধ্যে পড়ে বিমলা ঘুরপাক খেয়েছে, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু সে কোনো মতবাদকেই নিজের বলে গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ পারেনি নিজের নির্দিষ্ট কোনো মতবাদকেও প্রতিষ্ঠিত করতে। শেষের কবিতায় যদি আসি তবে আমি বলব, আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বলব যে, কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা রচনা না পড়ে থাকেন তবু এ একটি উপন্যাসই রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নিতে বোধকরি কষ্ট হবে না। অসুবিধা হবে না এ কথা বুঝতে যে, রবীন্দ্রনাথ কত বড় শিল্পী। শেষের কবিতায় গান আছে, কবিতা আছে, নাটক আছে, গল্পও আছে।
অমিত ও লাবণ্যের প্রণয় কাহিনী এক অতুলনীয়। অমিত সদা চঞ্চল, সব প্রথামুক্ত, তার কর্মে একটা বিচিত্র লীলায়িত ছন্দ আছে, নৃত্যশীল গতি আছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অনুপস্থিত। অন্যদিকে লাবণ্য নিত্যসংসারের বন্ধনের মধ্যে সূর্য ওঠা সকালবেলার মতো স্পষ্ট। তার মধ্যে অস্পষ্টতার মোহ নেই। সবটাই তার বুদ্ধিতে পরিব্যক্ত। লাবণ্যের ভালোবাসা অন্তপুরীর মঙ্গলপ্রদীপ। লাবণ্য রক্ষার প্রতীক। অমিত সৃষ্টির প্রতীক। তাই অমিতের মুখে শুনি, 'আমাদের সবচেয়ে বড় যে পাওনা সে মিলন নয় মুক্তি।'
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ূন, গান শুনুন, গল্প-উপন্যাস-নাটকের পাতা উল্টাতে থাকুন, পড়তে থাকুন তার অগণিত প্রবন্ধ ও চিঠি, চোখ মেলে দেখুন রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলো। দেখবেন, সবকিছু মিলিয়ে তারা একজন রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছে। আপনি-আমি যখন যে কথা ভাবছি কিন্তু যখন বলতে যাব তখন ঠিক বলতে পারছি না। লিখতে যাব, থেমে যাচ্ছি বারবার_ সেখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানেই তিনি। তারই মায়ার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সে হাতে হাত রেখে পরম নির্ভয়ে আমরা জীবনের সাঁকো পার হয়ে যেতে পারি, প্রবেশ করতে পারি এক গভীর চেতনার অলৌকিক ভুবনে।
রবীন্দ্রনাথ শুধু গল্পে নয়, কবিতায় নয়, গানে নয়, উপন্যাসে নয়, নাটকে নয়, চিঠিতে নয়, প্রবন্ধ বা ছবিতেও নয়। রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ শুধু জীবন ও প্রকৃতির বর্ণনাকারী কবিই নন, তিনি জীবন ও প্রকৃতির পরিচয় উন্মোচনকারী কবি। রবীন্দ্রনাথের প্রেম উত্তেজনা আর উন্মাদনার প্রেম নয়। দেহের অস্তিত্ব স্বীকার করেও তা এক দেহাতীত প্রেম।
আজকের এই ছোট্ট লেখায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজোড়া কীর্তিকে তুলে ধরা আমার মতো অতি সাধারণ সামান্য একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তার স্মরণ দিবসে আমার ভালোবাসার পুষ্পাঞ্জলিটুকুই তাকে নিবেদন করলাম। আর তারই রচিত দীপ্তিময় প্রেমের এষড়ৎরড়ঁং ষরমযঃ ড়ভ ষড়াব-এর অমর সৃষ্টি শেষের কবিতার অমর দুটি লাইন আমার প্রিয় কবিকে উপহার দিলাম, 'তোমাকে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান গ্রহণ করেছ যতো, ঋণী ততো করেছ আমায়।' হে বল্পুব্দ। না। না বিদায় বলব না। কারণ রবীন্দ্রনাথকে কোনোদিনই বিদায় দেওয়া যাবে না। বিদায় দেওয়ার অর্থ তো তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। অরুণ কি বিদায় দিতে পারে তার আকাশকে? আকাশ কি কখনও বিদায় দিতে পারে পূর্ণিমার চাঁদকে? লাবণ্য অমিতকে বিদায় দিয়ে শেষের কবিতা লিখেছেন পত্রাকারে। কিন্তু লাবণ্য কি অমিতকে আসলেই বিদায় দিতে পেরেছিল? কোনো প্রেমিকা পারে কি তার প্রেমিককে বিদায় দিতে? পারে কি কোনো
প্রেমিক তার প্রেমিকার সঙ্গে সব সম্পর্ক
চিরদিনের জন্য ছেদ করে দিতে? যদি সে প্রেম অগি্নপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে। যদি সে প্রেমে প্রেমের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত না থাকে। ভালোবাসা কথাটা বিয়ের চেয়েও কি জ্যান্ত নয়? প্রেম বিয়ের চেয়েও কি ব্যাপক ও বড় নয়? 'বিয়ে রক্ষা করে আর প্রেম মুক্ত করে জীবনকে।' আমার কাছে শেষের কবিতায় কোনো ঋৎঁংঃৎধঃরড়হ নেই। তবে চধরহ আছে, চাপা বেদনা আছে। কিন্তু সে বেদনা তো অসীমকে সীমার বাঁধনে না বাঁধতে, না পারার বেদনা। ইংরেজি কবি গধঃযব িঅৎহড়ষফ চিরকাল বিলাপ করে গেছেন এ দুই সত্তার মিলিত হতে না পারার বেদনায়। সত্যিকার প্রেমের প্রার্থনায় বিলাপ তো থাকবেই, থাকবে আহাজারি_ প্রেমের সব প্রার্থনা দৃশ্যমান, বস্তুর মধ্যে নিমিষে হারিয়ে গেলে অদৃশ্য আত্মার মাঝে সেই পবিত্র আলো ঈবষবংঃরধষ ষরমযঃ কীভাবে ধরা দেবে? প্রেম কি এতই সহজ? ঝড় ঈযবধঢ়? অমিত লাবণ্যের প্রেম বিয়ের বৃত্তে যুক্ত হলো না সত্যি। কিন্তু সে প্রেম মুক্ত বিহঙ্গের পাখনায় চিরকালের জন্য কি যুক্ত হয়ে রইল না? হে বিহঙ্গের যাত্রা হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।
আচ্ছা! দান্তে বিয়েত্রিচকে বিয়ে করলে সে কি আর কোনোদিন উরারহব পড়সবফু লিখতে পারতেন? রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই ঞৎধমবফু হতে হতে ঈবষবংঃরধষ ষরমযঃ-এর আলোতে উরারহব পড়সবফু হয়ে গেছে যেন। তাই তো বলি, আমাদের জীবনের সব অনুভূতির ভূমিতেই রবীন্দ্রনাথের সদা বিচরণ। রবীন্দ্রনাথ সমকালের নয়, চিরকালের। আমাদের জীবনের পরতে পরতে তার পরশ। একশ' নয়, দেড়শ' বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ তাই আজ, এখন, এ মুহূর্তেও একেবারে প্রাসঙ্গিক।

আতিকুল হক চৌধুরী : নাট্যকার
মিডিয়াব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.