দূর থেকে ভেসে আসে... by অজয় দাশগুপ্ত

একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর তা দ্রুতই ছড়িয়ে দেয় দেশের সর্বত্র। বাঙালিদের তারা উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার দাবি তোলা তাদের কাছে ছিল চরম ধৃষ্টতা। এক একটি এলাকা তাদের দখলে এসেছে, আর মানুষ মারা হয়েছে পাখির মতো গুলি করে কিংবা বেয়নেটে খুঁচিয়ে।


বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকাও ব্যতিক্রম ছিল না। পাক আর্মির কাছে মানুষ মারা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল নিত্যদিনের খেলার মতো। ১৪ মে তারিখটিও (৩০ বৈশাখ, ১৩৭৮) ছিল এমনই একটি দিন। তবে গণমানুষের অসম সাহস ও দৃঢ়তার কাছে সেদিন তাদের চরম পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল।
৪ পাকিস্তানি সৈন্য রাইফেল ও সাবমেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ইল্লা থেকে মাটির রাস্তা ধরে চলতে থাকে পশ্চিম দিকে। এ বার্তা পেয়ে শপথ নেন দোনারকান্দি ও নবগ্রামের অনিল চন্দ্র মলি্লক, প্রফুল্ল হালদার, দেবেন্দ্রনাথ সরকার, চিত্ত বলসহ শত শত মানুষ_ হানাদারদের আজ ফিরে যেতে দেব না। তাদের নেতা ২২ বছরের অনিল মলি্লক। অস্ত্র ল্যাজা-বল্লম, সড়কি, ঢাল, কাতরা, তীর-ধনুক, দা, বঁটি এবং লাঠি। যে যা পেয়েছেন হাতে তুলে নিয়েছেন। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত আকাশ-বাতাস। তাতে কখনও চাপা পড়ে যেতে থাকল গুলির কান ফাটানো শব্দ। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের রাইফেল তাক করতে দেখলেই শুয়ে পড়েন, আবার কয়েক পা এগোন এবং এভাবেই খুব কাছে এসে পড়েন খানসেনাদের। এমন যুদ্ধবিদ্যা কেউ তাদের শেখায়নি। অবিরাম গুলির মধ্যেই এক সময়ে তাদের মহাআবিষ্কার_ গুলি গায়ে লাগে না বরং বেতের ঢালে লেগে ছিটকে যাচ্ছে। এক সময়ে অনিল মলিল্গক হয়ে উঠলেন আরও সাহসী। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, 'ওই তো খানসেনা, ধর ধর।' চরম উত্তেজনায় আকস্মিকভাবেই তিনি জাপটে ধরেন এক খানসেনাকে। দু'জনের ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সৈন্যটি তাকে গুলি করে। গুলি লাগে ঊরুতে। আরেক সৈন্যও তাকে গুলি করতে উদ্যত হলে প্রফুল্ল হালদার রাইফেলটি বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নেন এবং তা দিয়ে আঘাত হানেন সৈন্যটির মাথায়। আঘাতে এত জোর ছিল যে রাইফেলটির বাঁট ভেঙে যায়। এ সময় দেবেন্দ্রনাথ সরকারও আরেক সৈন্যকে বল্লমের ঘায়ে ধরাশায়ী করে ফেলেন। দুই সৈন্যের এ পরিণতি দেখে অন্য দু'জন প্রাণভয়ে পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পড়ে যায় খালের মধ্যে। তাদেরও হত্যা করা হয়। এ মহাসমরের নায়ক অনিল মলিল্গক ক্রমাগত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরদিন দোনারকান্দি এলাকায় প্রতিশোধ মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশাল বাহিনী নিয়ে। এ হামলার শঙ্কা থেকেই শত শত মানুষ পালিয়ে আরও পশ্চিম দিকে 'নিরাপদ আশ্রয়ে' চলে যায়। আর্মির বীরত্ব দেখানোর জন্য পড়ে থাকে কেবল পরিত্যক্ত বাড়িগুলো। চারদিক শুধু আগুন আর আগুন। জ্বালিয়ে দেওয়ার লোক আছে, নেভানোর কেউ নেই।
আর্মি সন্ধ্যা নামার আগেই গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে ফেরত যায়। ঠিক এ সময়েই মিহির দাশগুপ্ত ও আমি চলেছি দোনারকান্দির পথে। একটি টর্চলাইট আমাদের পথ দেখায়। অল্প জলে ডুবে থাকা মাঠের পর মাঠ পার হয়েছি হেঁটে। পোড়া গন্ধ আর ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা আমাদের স্বাগত জানায়। কথা বলার মতো পেয়েছিলাম মাত্র একজনকে। অস্ফুট বাক্য তার কণ্ঠে_ কেউ নেই, কিছু নেই। দুই ঘণ্টা পর আমরা দু'জন ফিরে চলেছি। জমির আইল ধরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মধ্যে পড়ে যাচ্ছি ইরি ধানের ক্ষেতে। এমন সময় কিশোর কিংবা বালকের কণ্ঠে ভেসে এলো, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...'। শুদ্ধ সুরে তা গাওয়া হয়নি। কিন্তু কী মধুর ধ্বনি, কী অবিনাশী প্রেরণা। অসুর বধের বাড়তি সাহস মিলল এতে। এ যে 'রক্তকরবী'র নন্দিনী। গণ্ডগ্রামের এ কিশোর নিশ্চিতভাবেই সে লেখা পড়েনি। রবীন্দ্রনাথ কে সেটাও হয়তো জানে না। এক অদ্ভুত ভালোলাগা আমায় আপ্লুত করে ফেলে। ধ্বংসস্তূপ দেখে এসেছি, পাকসেনাদের পরের টার্গেট হবে কোন এলাকা ভেবে মনে দারুণ শঙ্কা। কিন্তু দূরে কিংবা আরও দূরের ওই কণ্ঠ ফিরিয়ে দেয় সাহস। আমরা হার মানব না।
 

No comments

Powered by Blogger.