রূপক কাহিনি by লুনা রুশদী

তখন কুয়াশা ছিল এখানে সন্ধ্যা হচ্ছে এখন। এই সময়টাকে গোধূলি বলে বোধহয়। আমার কেমন শীত লাগে একটু একটু। আর পাশের বাড়িতে কুকুরটা ডাকছে শুনতে পাই। আজকে আমি প্রায় সারা দিন আমার ঘরে ছিলাম। একবার বোনকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে গেছিলাম, সেই সময়টা বাদে। তখন কুয়াশা ছিল রাস্তায়।


আর আমার একটা বইয়ের কথা মনে হচ্ছিল। কে লিখেছিল ভুলে গেছি। নাম হলো ‘তখন কুয়াশা ছিল’। বইটা কী নিয়ে তাও ভুলে গেছি। আর শেষমেষ পড়েছিলাম কি না, সেটাও একটুও মনে নাই। কিন্তু নামটা রয়ে গেছে। কেমন একটা স্মৃতি মেশানো দুঃখ নামটায়। মনে হলেই একসঙ্গে কত কিছু মনে পড়ে। ছোটবেলার শীতকাল। গ্রামের কুয়াশা...বাইরে মাটির চুলায় রান্না, আর চুলার আগুনে ঠিক আশপাশটা কেমন আলোকিত। চাচির মুখ, আম্মা, দাদি। আমরা টুলে বসে থাকতাম। আগুনের আঁঁচ আসত। ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়ায় আলাদা দাম দিত গ্রামের সবাই। কত লোক দেখতে আসত। আব্বার সাথে মিটিংয়ে বসত। আর আমি সব টুকরো শব্দ, কথা শুনতাম আর কিছুই শুনতাম না। শুধু দেখতাম মাটির চুলার ভিতরে লাল আভা, আর ঠিক পাশে পাশে কালো ধোঁয়া আর পাটকাঠি পোড়ানো কেমন গন্ধ একটা। ওই গন্ধটা আমার কাছে মনে হয় শীতকালের গন্ধ। যখন কুয়াশা থাকে, আর সবাই একসঙ্গে থাকে আগুনের আশেপাশে। আর পৃথিবীটা ছোট হয়ে একটা উঠানে এঁটে যায়। আর কোথাও শূন্যতা থাকে না...,
এখন আমার ঘরের পেছনের বাগানের অংশটায় আলো কমে গেছে। আর কুকুরগুলো এখনো ডাকছে। পাখি নেই একটাও। সবাই ফিরছে কোথাও, ক্লান্ত হয়তো। দিন শেষ হচ্ছে। লেবুর চারা-গাছটার পাশে একটা লেবু পড়ে আছে বেড়ার কাছ ঘেঁষে, ঠিক যেখানে কিছুটা ঘাস হলুদ হয়ে আছে, সেখানেই হালকা সবুজ হয়ে ফুটে আছে লেবুটা। দেখতে ভালো লাগে। এখান থেকেও বোঝা যায় কেমন গন্ধ হবে, আর ছুঁয়ে দেখতে কেমন।
আমি ঘরে আলো জ্বালিনি। অন্ধকার ভেতরটা, আর অগোছালো। আমি কিছু দেখছি না। একটু একটু শীত লাগছে আমার। আর একটাই লাইন ঘুরছে মনের ভেতর। তখন কুয়াশা ছিল, কখন ছিল? কোথায়? কেমন কুয়াশা? এখন কী আছে অথবা কী নেই?
বেড়ার রংটা ছাই ছাই। দিনটা যত সন্ধ্যার দিকে যেতে থাকে, আমার কেমন মনে হয় বাগানটা দুঃখী হয়ে যাচ্ছে। আরও গাঢ় রঙ নিতে থাকে। মনে হতে থাকে, যত গাঢ় হচ্ছে আমাদের না-বলাগুলো বেড়ে যাচ্ছে, আর দূরে সরতে থাকাটাও—আমরা চুপ হয়ে যাচ্ছি ততই আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই বলার থাকছে না।
অথচ, আজকে দুপুরে খুব সুন্দর রোদ ছিল। ঘাসের উপর রোদ ঝলমল করছিল। সেই রোজেলা পাখিটা এসেছিল আজকেও। তার গলায় লাল রং আর সারা গায়ে সবুজ হলুদ মেশানো। খুব গর্বিত ভঙ্গিতে হাঁটছিল বেড়ার ওপরে। আমি পাখিটাকে দেখছিলাম, রোদ দেখছিলাম, লাউ গাছ মরে যাওয়া খালি মাচা দেখছিলাম আর কয়েকটা খালি ফুলের টব বোকার মতো ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে রোদ খাচ্ছিল, তাও দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম আমি অমল হয়ে গেছি। আমার বিছানার কাছে জানালা আর সেখানে পৃথিবী চলতে থাকছে, আমি থেমে আছি শুধু আর দেখছি, আমাকে কেউ দেখছে না।
এ রকম ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আমি নড়ছি না, যাচ্ছি না কোথাও। আলো কমে আসছে, আমি ঘরেও আলো জ্বালছি না। আর একটু শীত শীত করছে আমার।

এ চিঠির নেই জবাব দেবার দায়...
এখন দুপুর রোদ। বৃষ্টি নেই আজ। ছিল গতকাল এবং তারও আগে আরও। এখন রোদ। আর ঘাসের ওপর বাতাস সরে যায়। তাকে দেখা যায় না, তার সরে যাওয়া দেখা যায় শুধু। একটা শালিক পাখি একা একা হয়ে কি যেন খুঁজছে, পাচ্ছে না কোথাও । বহু দূর থেকে আগের জন্মের স্মৃতির মতো একটা ঘুঘু ডাকছে। ডাকটা ছড়াচ্ছে। আর নীরব দুপুরটাকে নিঝুম করে দিচ্ছে আরও।
একদম নীরব না। রান্নাঘরে আম্মা গান বাজাচ্ছে সাগর সেনের গলায়—
‘কেমনে সে হেসে চলে যায়
কোন প্রাণে ফিরেও না চায়
এত প্রেম এত সাধ
করে অপমান...’
সুরটা বাতাস হয়ে আমার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। আর ঘুরছে ঘুরতে থাকছে।
আমার কোনো কথা নাই। আমাদের আর কোনো কথা নাই। তবু আমরা কথা বলি দিনরাত, রাতদিন।
আমরা প্রশ্ন করি,
‘ওই দিন ওই সময়ে সেই রকম বৃষ্টিতে কী রকম লাগল তোমার?’
আর উত্তর দেই ‘কী জানি!’ তারপর আমরা হাসি। তারপর বলি—
‘সেদিন বাসের জানালায় শহরটা কেমন পেছন দিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল আর তুমি ভোরের দিকে যাচ্ছিলে।’
আমার ট্রেনের জানালায় তখন সন্ধ্যা নামছিল, আর বহুদিন আগে ফেলে-যাওয়া ভুলে-যাওয়া শহরটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। একটু পরেই রাত হয়ে যাবে। আমি ভাবছিলাম।
ঘাসগুলো বাদামি হয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে ওরা। ঘাসেরা মরে যায়। আমরা জানি, দেখি না কিছু তাই।
আবার সবুজ ঘাস দেখি আমরা। আর ভুলে যাই বাদামি ফুরিয়ে-যাওয়া ঘাসগুলোও ছিল কখনো। তাদের একসময়ের অস্তিত্ব, তাদের না-থাকার সাথেই চলতে থাকবে সমান্তরাল। এসব আমরা ভাবি না। আমরা বলি ঘাস তো ঘাস, আর সবুজ।
আমরা গান শুনি আর কবিতার কথা বলি। কোন কবি কোন কবিতায় গোলাপ ফুলের কথা বলেছিলেন, পড়তে পড়তে অবাক হই আর বলি, ‘কী আজব!’ এক একটা শব্দের মধ্যে শূন্যতাগুলি ভাবি আমরা।
তুমি বলো, ‘কী করো?’
আমি বলি, ‘কিছু না।’
আমি কদম ফুলের কথা বলি। কদম একটা জোস ফুল। গোলের মধ্যে গোলের মধ্যে গোলের মধ্যে গোল! আবার অনেক হাসি।
অনেক কথা বলি আমরা। কিছুই বলি না!

No comments

Powered by Blogger.