নীতিমালা চূড়ান্ত-চিকিৎসকদের শিক্ষাছুটির রাশ টেনে ধরছে সরকার by শেখ সাবিহা আলম

চিকিৎসকদের শিক্ষাছুটির অপব্যবহার রোধে সরকার নতুন নীতিমালা করেছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে সরকারি চিকিৎসকেরা শিক্ষাছুটি নিয়ে বছরের পর বছর শহরে থাকতে পারবেন না। এতে শিক্ষাছুটিতে থাকা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত রোগী দেখাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।


‘স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রেষণ নীতিমালা, ২০১২’ নামের এই নীতিমালা গত ২৯ মে চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রেষণে আসা চিকিৎসকদের মুচলেকা দিতে হবে যে ডিগ্রি অর্জনের পর তাঁরা ন্যূনতম পাঁচ বছর সরকারি চাকরি করবেন। কোনো চিকিৎসক ওই পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলে তাঁকে ১৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। জানুয়ারি-২০১২ সেশনে ভর্তি হওয়া চিকিৎসকেরা এর আওতায় পড়েছেন।
একাধিক সরকারি সূত্র বলছে, কর্মস্থলে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি বাড়াতে সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। অভিযোগ আছে, শহরে থাকার জন্য অনেক চিকিৎসক শিক্ষাছুটি নেন। ছুটি নেন কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে আবার ছুটি নেন। একসঙ্গে একাধিক কোর্সে ভর্তির নজিরও আছে। কেউ কেউ এক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পর অন্য বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রির জন্যও ছুটি নেন। এর ফলে চিকিৎসকদের একটি অংশ বছরের পর বছর রাজধানীতেই থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রেষণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এক দিনও যেন কোনো চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত না থাকেন, সে জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে প্রেষণ ও প্রশিক্ষণের জন্য পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশে আরও বলা হয়েছে, কোর্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অধিদপ্তর পদায়নের আদেশ জারি করবে। এতে করে কোর্স শেষ হওয়ার পরপরই প্রত্যেক কর্মকর্তা তাঁর কর্মস্থলে যোগ দিতে পারবেন, অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও চিকিৎসা) আকতারী মমতাজ প্রেষণ নীতিমালা করার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, অনেক সরকারি চিকিৎসক দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি নিয়ে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি শেষ করেন। অনেকেই সময়মতো বিভিন্ন পর্যায় (পার্ট ওয়ান, পার্ট টু ইত্যাদি) পাস করতে পারেন না। তাঁরা কর্মস্থল ছেড়ে বারবার প্রেষণ বা অসাধারণ (বেতন ছাড়া) ছুটি নিতে থাকেন। এর ফলে মাঠপর্যায়ে চিকিৎসকের সংকট দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের অসংগতি দূর করা দরকার।
তবে নতুন নীতিমালা নিয়ে চিকিৎসকদের একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এমন কোনো নীতিমালা চাই না, যাতে শিক্ষা সংকোচন হয়। আগে চিকিৎসকেরা একবারে কোনো পরীক্ষায় পাস করতে না পারলেও বিনা বেতনে অসাধারণ ছুটি পেতেন। সে সুযোগটা এখনো থাকা দরকার।’ তিনি বলেন, প্রেষণে আসার শর্ত হিসেবে মুচলেকা দেওয়ার যে বিধান রাখা হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত। কারণ সরকারি চিকিৎসকের উচ্চশিক্ষার ব্যয় সরকার বহন করে।
এদিকে বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক, কান, গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুচলেকার বিধান যেকোনো মূল্যে বাতিল করতে হবে। অন্য কোনো ক্যাডারে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য এমন বিধান রাখা হয়নি।
নীতিমালার উল্লেখযোগ্য দিক: প্রেষণ নীতিমালা-২০১২তে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরির মেয়াদ ন্যূনতম দুই বছর পূর্ণ হওয়ার পর বিভিন্ন কোর্সে/প্রশিক্ষণে চিকিৎসকদের প্রেষণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে প্রাতিষ্ঠানিক চাহিদা অনুযায়ী। এফসিপিএস (ফেলো অব দি কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স) প্রথম পর্বে সরাসরি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকায় এর জন্য প্রেষণ বা কোনো প্রকার ছুটি দেওয়া হবে না। এফসিপিএস দ্বিতীয় পর্বের কোর্স এক বছর মেয়াদি হওয়ায় এই কোর্সটি শেষ করার জন্য ঠিক এক বছরের প্রেষণ দেওয়া হবে। যেকোনো কোর্সের কোনো পর্বের জন্য অনুমোদিত প্রেষণের সময় পুরো ভোগ করার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে ওই কোর্সের জন্য নতুন করে আর প্রেষণ মঞ্জুর করা হবে না।
অভিযোগ আছে, চিকিৎসকেরা শহরে থাকার জন্য একটির পর একটি কোর্সে নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী কোনো বিষয়ে নিম্নতর স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি করলে পরে ওই বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে উচ্চতর কোর্স করতে পারবেন না। যেমন, কোনো স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিষয়ে ডিপ্লোমা করলে কেবলমাত্র সে বিষয়ে এমএস/এফসিপিএস করার সুযোগ পাবেন।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর প্রার্থীর নিম্নতর কোর্সে অধ্যয়নের আবেদন বিবেচনা করা হবে না। ফলে কোনো প্রার্থী এমএস, এমডি, এমফিল, পিএইচডি, এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করার ডিপ্লোমা বা সমমানের কোর্সের জন্য বিবেচিত হবেন না।
নীতিমালায় যেকোনো শিক্ষাছুটিতে থাকার সময় চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা ব্যক্তিগত রোগী দেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.