সপ্তাহের হালচাল-বেতন-বোনাস দিন, ট্রেড ইউনিয়নও দিন by আব্দুল কাইয়ুম

পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। সামনে ঈদ। নতুন বর্ধিত বেতন-স্কেলে বোনাস না পেলে তাঁরা মানবেন কেন? গত সপ্তাহে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী নতুন বেতনকাঠামো অনুযায়ী বোনাস দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।


কিন্তু গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি বলেছেন, না, বোনাস হবে পুরোনো বেতনকাঠামোয়! দুরকম কথার ফল কখনো ভালো হয় না। উৎপাদনমজুরি কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগে গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকেরা ভাঙচুর করেছেন। কালিয়াকৈরের শ্রমিকদের অভিযোগ, অন্যান্য মাসের তুলনায় চলতি মাসে পিসপ্রতি মজুরি ছয়-সাত টাকা কম দেওয়া হয়েছে। যেখানে মজুরি বাড়ানোর কথা, সেখানে যদি কমানো হয়, তাহলে কার মাথা ঠিক থাকবে?
আন্দোলনে নামলে বলা হয়, ষড়যন্ত্র! ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু আপনি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবেন না, আর তাঁরা প্রতিবাদ করলে বলবেন, বহিরাগতদের চক্রান্ত, তা হয় না। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে মালিকেরা বলেন, অবস্থা খারাপ, বেশি বেতন-বোনাস দিতে গেলে নাকি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বাজে কথা। আজ পর্যন্ত কজন পোশাকশিল্পের মালিক গরিব হয়ে পথে বসেছেন? হয়তো একজনও নয়। কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিক আয়-উপার্জন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
৪ নভেম্বর প্রথম আলোর শীর্ষ সংবাদে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের অপার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ফ্রান্সে নতুন বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশ পাবে বৈদেশিক মুদ্রা। মালিক গড়ে তুলবেন সম্পদের পাহাড়। আর শ্রমিকেরা কিছু পাবেন না? আপনি শ্রমিককে দিন, শ্রমিক আপনাকে দেবেন। এটাই তো আধুনিক শিল্পব্যবস্থাপনা। আর আপনি যদি না দেন, তাহলে শ্রমিক কেন আপনাকে দেবেন? ২০০৬ সালে পোশাকশিল্প শ্রমিকেরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে তাঁদের ঠান্ডা করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিকল্পিতভাবে একটা প্রচার চালানো হয় যে ‘পার্শ্ববর্তী’ একটি দেশ বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। তারপর তো তাঁদের বেতন কিছু বাড়ানো হলো। ১৬০০-১৭০০ টাকায় চলা কষ্ট, তা-ও তাঁরা মেনে নেন। এরপর চার বছর কেটে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কয়েক মাস আগে শ্রমিকেরা যখন আবার মজুরি বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নেমে এলেন, তখনো সেই পুরোনো ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ শোনা গেল। শ্রমিকদের অসন্তোষ ঠান্ডা করার জন্য কয়েকজন শ্রমিকনেতাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হলো।
এভাবে বল প্রয়োগ করে কি শ্রমিকদের কম মজুরিতে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য করা যাবে? চুক্তি করে মজুরি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার পরও কেন তা সবখানে বাস্তবায়িত হবে না? কেন কয়েক দিন পরপর শ্রমিক অসন্তোষ? এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে।
আসলে শ্রমিকদের শুধু কিছু মজুরি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিতে হবে। বেতন তো লাগবেই। তার পরও অনেক অভাব- অভিযোগ থাকে, এসব মীমাংসার জন্য লাগে তাঁদের ইউনিয়ন। প্রায়ই অভিযোগ ওঠে যে সাপ্তাহিক ছুটি নিয়মিত দেওয়া হয় না, ওভার টাইমের পাওনা পরিশোধে দেরি হয় এবং শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়—এসব নিত্যদিনের সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? কে করবে? একেকটা দাবি উঠবে আর শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙচুর করবেন? কারখানায় আগুন দেবেন? এটা হয় না। শ্রমিকদের ইউনিয়নের নির্বাচিত নেতা থাকবেন। মালিকপক্ষের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করে মীমাংসায় আসবেন। তাহলে শ্রমিকদের আর রাস্তায় নামতে হবে না। যদি তাঁদের ক্ষোভ থাকে, থাকবে শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে। শিল্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য এটা দরকার।
শুধু পোশাকশিল্পে নয়, দেশের কোনো কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের সত্যিকার অর্থে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) নেতারা সেদিন প্রথম আলোর অফিসে এসে এ কথাটাই বলে গেলেন। তাঁদের দাবি-দাওয়ার কথা ৩ নভেম্বর পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। অনেক দাবি। তবে প্রধান ও মৌলিক দাবিটি হলো, আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮-এর ভিত্তিতে সব কারখানা-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পছন্দমতো নেতা নির্বাচিত করার অধিকার দিতে হবে। বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার অবশ্য আইনে আছে, কিন্তু শর্ত হলো, নেতাদের হতে হবে সেই কারখানার শ্রমিক। সেদিন প্রথম আলোর অফিসে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি, একসময়ের বাওয়ানি জুট মিলের সিবিএ নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরী বললেন, এই শর্তটি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে বিরাট বাধা। সাহসী কোনো নেতা নির্বাচন করা হলে মালিক নানা অজুহাতে তাঁকে কারখানা থেকে বরখাস্ত করেন, তখন আইনের শর্তের কারণে তিনি আর ট্রেড ইউনিয়নের নেতা থাকতে পারেন না। ফলে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষাকারী ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব বেসরকারি শিল্প কারখানায় এখন প্রায় নেই। সরকারি মালিকানাধীন কারখানায় ইউনিয়ন ও সিবিএ থাকলেও তা সব সময় ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে আর নিজেরা নানা অনৈতিক পথে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে শ্রমিকদের তেমন কোনো উপকার হয় না। শ্রমিকদের শৃঙ্খলার মধ্যে ধরে রাখার বৈধ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক-ব্যবস্থা নেই। অসন্তোষ দানা বাঁধলে রাস্তায় না নেমে তাঁদের উপায় থাকে না। এ জন্য কোনো ষড়যন্ত্রের দরকার হয় না।
একটা কারখানাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন তার শ্রমিকেরা। কারণ তাঁরা জানেন, এটা তাঁদের রুটি-রুজির উৎস। কোনো শ্রমিকই চান না, কারখানা ধ্বংস করতে, কারণ কারখানা না থাকলে বেতন দেবে কে? তিনি বাঁচবেন কীভাবে? শ্রমিকদের এই মনোভাব আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জেনেছি। তখন পাকিস্তান আমল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। দলবেঁধে গেলাম আদমজী পাটকলে। শ্রমিকদের জীবন সম্পর্কে জানা-বোঝার জন্য। সেদিন দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা শ্রমিকদের কাছে যাওয়ায় তাঁরা কতটা উদ্দীপিত হয়েছেন। আরও দেখেছি, শ্রমিকেরা তাঁদের কারখানাকে কত আপন মনে করেন। আরেকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী মিলে আমরা গেলাম ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেওয়ার জন্য। সেখানে ধর্মঘট চলছিল। শ্রমিকেরা অনশন করছিলেন। আমরা বললাম, ‘আপনাদের সঙ্গে আছি, আপনাদের সংগ্রাম নিশ্চয়ই সফল হবে।’ পরে একজন শ্রমিক বললেন, ‘আমরা’ আর ‘আপনারা’—এইভাবে আমাদের মধ্যে দেয়াল তুলে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন কেন? কেন বললেন না, ‘আমাদের সংগ্রাম সফল হবে।’
এই ঘটনা আমাদের মনে একটা ঝাঁকুনি দিল। শ্রমিকেরা যে আমাদেরই ভাই, আমাদেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, এভাবে আমরা কেন দেখি না?
সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদী তত্ত্বের উদ্ভাবক জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স দেড় শ বছর আগে রচিত তাঁর ঐতিহাসিক পুঁজি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে পুঁজিবাদী-ব্যবস্থা নিজের এবং অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থেই শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং সব কারখানায় তার বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করে। আমাদের দেশে প্রকৃত শিল্পপতিদের অনেকে তাঁদের কারখানায় নিয়ম অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে উৎসাহিত করেন। কিন্তু অনেক শিল্পপতি তা করেন না। শ্রমিকদের ঠকিয়ে কোনো শিল্পপতি কখনো সুষ্ঠু শিল্প গড়ে তুলতে পারেন না। শ্রমিকদের ঠকিয়ে, ফটকাবাজি করে শিল্পপতি হওয়া যায় না।
ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের বিষয়ে অধ্যাপক মো. ফসিউল আলমের সঙ্গে কথা বলছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক ৩২ বছর ধরে এ বিষয়ে গবেষণা ও কাজ করছেন। শ্রম আইন ও সিবিএ বিষয়ে তিনি পিএইচডি করেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন গঠন, পরিচালনা ও স্বীকৃতি প্রদান সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা জানি, ইপিজেডে আলাদা আইন আছে। সেখানে কল্যাণ সমিতি আছে। কিন্তু সেটাও ঠিকভাবে কাজ করে না। অনেক সময় সমস্যা হয়।
আইএলওর বিধান অনুযায়ী, সব দেশে শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানে একটি জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শমূলক কমিটি আছে। সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটির নিয়মিত বৈঠকে শ্রম পরিস্থিতি আলোচনা এবং সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়মিত সভা হয় না। আর কমিটিও প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবেই থাকে। ফলে এই কমিটির কাজের সুফল শ্রমিকেরা পান না। ত্রিপক্ষীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার জন্য গত বছর ২৬-২৭ অক্টোবরে শ্রীলঙ্কায় সাত জাতির সম্মেলনে অধ্যাপক মো. ফসিউল আলম আইএলওর ঢাকার প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যোগদান করেন। সেখানে ভুটান ছাড়া এ অঞ্চলের ছয়টি দেশ ও চীনের প্রতিনিধিরা ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আইএলওর প্রতিনিধি। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে সবকিছু আলোচনা করা হয়। দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে ত্রিপক্ষীয় কমিটির কাজে যেমন সাফল্য আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতা। আমাদের দেশে শ্রম-অসন্তোষ দূর করতে একদিকে যেমন অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের স্বীকৃতি দরকার, তেমনি দরকার ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক কমিটির সক্রিয় ভূমিকা। শ্রীলঙ্কার সম্মেলনে আইএলওর ঢাকা অফিসের জন্য এই মর্মে সুপারিশ করা হয়, তারা যেন আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮ অনুসারে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ কমিটির অংশীদারদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে এবং একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ‘শ্রম কমিশন’ গঠনে সহায়তা দেয়।
এটা ঠিক যে আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়নের কিছু নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা আদায়ের অনেক ঘটনা এ দেশে ঘটেছে, এখনো ঘটছে। কিন্তু এ জন্য ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ থাকবে? মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলতে হবে? তা হয় না।
স্কপ শ্রমিকদের স্বার্থে অনেক দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছে। ন্যায্য দাবিগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সবকিছুর আগে অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারটুকু দেওয়া হোক। আর শ্রমিকনেতাদেরও দায়িত্ব আছে। সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত তাঁদের।
শ্রমশৃঙ্খলা এ মুহূর্তে দেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য খুব জরুরি।
আব্দুল কাইয়ুম : সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.