শিকাগো থেকে সিয়াটল-গাহি বাংলার জয়গান by সাইমন জাকারিয়া

দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো আমাকে পুরো এক মাসের জন্য ভিজিটিং স্কলার হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল। প্রেরিত আমন্ত্রণ পত্রের সুবাদেই আমি ১০ এপ্রিল শিকাগোতে পৌঁছাই। সেখানে আমি কাজ শুরু করি দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সাউথ এশিয়ান ল্যাংগুয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন বিভাগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক থিবো দুবেরের নেতৃত্বে।


এর একটা পূর্বসূত্র আছে, যা আমি ও থিবো উভয়েই উল্লেখ করি গত ১৯ এপ্রিল ইউনিভার্সিটির ফস্টার হলের ১০৩ নম্বর কক্ষে অনুষ্ঠিত দ্য সাউথ এশিয়া সেমিনার সিরিজের যৌথ বক্তৃতায়। বিষয় ছিল, ‘সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল: বাংলায় একটি আখ্যানের সাহিত্যিক ও নাট্যিক অভিযাত্রা।’ এটা ছিল থিবো ও আমার প্রথম যৌথ উপস্থাপনা।
অধ্যাপক থিবো দুবের তাঁর বক্তৃতার পূর্বসূত্র সম্পর্কে বলেন, ২০০৫-০৬ সালে তিনি যখন আলাওলের ওপর পিএইচডি গবেষণার কাজে ঢাকায় আমার কর্মক্ষেত্র বাংলা একাডেমীতে কাজ করছিলেন, তখন একদিন তাঁকে আলাওলের কাব্যাখ্যানের মধ্যে সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামালের আখ্যান ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিবেশিত হওয়ার একটি আগ্রহোদ্দীপক তথ্য দিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, তখন গ্রামাঞ্চলে পরিবেশিত সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামালের আলোকচিত্র প্রদর্শনসহ জনসংস্কৃতি সমীক্ষণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছিলাম তাঁকে। এ ছাড়া প্রণমহি বঙ্গমাতা গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে মুদ্রিত ‘এই দুনিয়ার মিছা মায়ায়’ শীর্ষক অধ্যায়ে নেত্রকোনা অঞ্চলের কিচ্ছা-গাতক দিলু বয়াতির সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল পালা পরিবেশনার বিবরণ অধ্যাপক থিবো দুবেরকে নতুন চিন্তায় উদ্দীপ্ত করে।
আমাদের যৌথ আলোচনার শুরুতে এই কথাগুলো বলে নিয়ে অধ্যাপক থিবো দুবের তাঁর আলোচনায় আরবি, তুর্কি, ফারসি, পাঞ্জাবি, হিন্দি ও সর্বোপরি বাংলা ভাষায় রচিত সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল কাব্যের সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিস্তৃত আলোচনা করেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে প্রাসঙ্গিকভাবে বিভিন্ন ভাষায় রচিত কাব্যের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির ছবি পর্দায় প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে আমি আমার আলোচনায় সমকালীন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল আখ্যান পরিবেশনার মৌখিক ও লেখ্য-ঐতিহ্যের বিবরণ উপস্থাপন করি। বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত মৌখিক ঐতিহ্য কিচ্ছার আসরে পরিবেশিত সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল পরিবেশনার বিশেষত্ব ও যাত্রার আসরে ব্যবহূত লেখ্য-ঐতিহ্যের বিবর্তন নিয়ে বিবরণ ও উপস্থাপনার ফাঁকে ফাঁকে আমি যাত্রা ও কিচ্ছার আসরের স্থির ও ভিডিওচিত্র ব্যবহার করি। সব শেষে প্রদর্শিত হয় আমার সংগৃহীত নেত্রকোনার দিলু বয়াতি পরিবেশিত সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল পালার একটি প্রামাণ্যচিত্র।
সমাগত সুধীমণ্ডলীর মধ্যে সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি টুব্ব, উর্দু বিভাগের অধ্যাপক মুজাফ্ফর আলম, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রোচনা মজুমদার, পালি ভাষার অধ্যাপক স্টিভেন কলিন্স, তামিল ভাষার অধ্যাপক সাসা ইবিলিং, মালয়ালাম ভাষার অধ্যাপক নিশা কমাতাম, লাইব্রেরির সাউথ এশিয়া বিভাগের বিব্লিওগ্রাফার জ্যামস এইচ নাই, উর্দু ভাষার শিক্ষক এলেনা বশীর, বাংলা বিভাগের শিক্ষক মন্দিরা ভাদুড়ী প্রমুখ আমাদের সেদিনের যৌথ উপস্থাপনার প্রশংসা করেন। তবে, প্রশংসার পাশাপাশি সেদিন আমরা অন্তত দুটি নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। এক. বিব্লিওগ্রাফার জ্যামস নাই-এর প্রশ্ন: বাংলাদেশের কোনো লাইব্রেরি আসরে ব্যবহূত লিখিত পাণ্ডুলিপির কোনো মুদ্রিত বা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করে কি না, বিশেষ করে যেসব পাণ্ডুলিপির কথা আমার আলোচনায় উল্লেখ করেছি; দুই. মন্দিরা ভাদুড়ীর প্রশ্ন: সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামালের আখ্যান পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা বা কিচ্ছার আসরে পরিবেশিত হয় কি না। অনেক প্রশংসার ভিড়ে এ দুটি প্রশ্ন আমাদের সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল আলোচনার ভবিষ্যৎ গতিপথকে আরেকটু সমৃদ্ধ করবে বৈকি।
প্রথম সেমিনার শেষ হতে না হতেই সাউথ এশিয়ান বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, অধ্যাপক থিবো দুবেরের বাংলা ও ফার্সি ভাষার ক্লাস পর্যবেক্ষণ করার ফাঁকে দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর কোসাল আয়োজিত দি থার্ড নরম্যান কাটলার কনফারেন্স অন সাউথ এশিয়ান লিটারেচার। এবারের কনফারেন্সের শিরোনাম ‘দুই বাংলা’। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দুজন সৃজনশীল লেখক এই কনফারেন্সের কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই লেখকদ্বয়ের একজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের ঔপন্যাসিক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, আর অন্য লেখকের তালিকায় বাংলাদেশের নাট্যকার হিসেবে আমার নামটি যুক্ত রয়েছে। নিজের নামটি সেখানে যুক্ত থাকার চেয়ে আনন্দের যে ব্যাপারটি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, তা হলো: ‘দুই বাংলা’র অনুষ্ঠানে আলোচক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সারা পৃথিবীর নামকরা সব বাংলা ভাষার অধ্যাপক-গবেষক।
২৭-২৮ এপ্রিল ২০১২ এই দুই দিন ‘দুই বাংলা’। প্রথম দিন সকাল সাড়ে নয়টায় অধ্যাপক থিবো দুবের বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে ‘দুই বাংলা’র অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন। শুরুতেই তিনি সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন আমার ক্যামেরায় ধারণ করা বাংলাদেশের বিচার গানের প্রখ্যাত সাধকশিল্পী আরজ আলী বয়াতির গাওয়া বিজয় সরকারের দুই বাংলাবিষয়ক গানের অডিও-ভিডিও উপভোগ করার জন্য। যে গানের বাণীর ভেতর লেখা আছে: ‘পশু পাখি কীটপতঙ্গ তাদের নাহি বঙ্গভঙ্গ/পূর্ব কিংবা পশ্চিম বঙ্গ সব যেন তাদের এলাকা/তারা এপার-ওপার ঘুরে বেড়ায় লাগে না সরকারি লেখা।’ বাংলা ভাষার এই গানের বাণীর ইংরেজি অনুবাদ উপস্থিত সুধীসমাজের হাতে হাতে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। এই গানের ভেতর দিয়ে ‘দুই বাংলা’ শিরোনামের কনফারেন্স শুরু হওয়ায় সবার ভেতর অদ্ভুত একটা আবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। যে সঞ্চারকে স্বাগত জানালেন সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি টুব্ব। এরপর অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী ও থিবো দুবের অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচিত লেখক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমার পরিচিতি উপস্থাপন করেন। কথা ছিল এই পরিচিতির পরই প্রধান আলোচনা উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক ইমেরিটাস ক্লিটন বি. সিলি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্লিটন পৌঁছাতে পারেননি বলে উপস্থাপনাসূচিতে একটু পরিবর্তন আনা হয়, অর্থাৎ সকালের সময়সূচিতে ক্লিটনের স্থলে বিকেলের উপস্থাপক ফরাসি অধ্যাপক ফিলিপ বেনুয়া প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ‘এপার বাংলা, ওপার বাংলা: তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রতিফলিত গ্রামীণ জীবন’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এরপর নির্বাচিত লেখক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস ‘সটীক জাদুনগর’-এর কিছু অংশ বাংলায় পড়ে শোনান, পাশাপাশি তার ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেন অধ্যাপক রোচনা ব্যানার্জি।
দুপুরের খাবার শেষে আমার নাটক পাঠের পর্ব। এই পর্বে আমি আমার বোধিদ্রুম নাটকের শেষ সাতটি অধ্যায় বাংলায় পাঠ করি, আর দুরদানা গিয়াস অনূদিত সেই অংশের ইংরেজি পাঠ করেন অধ্যাপক জ্যাসন গরনিবাম। নাটকের পাঠের পর অধ্যাপক টনি কে. টুয়ার্ট, অধ্যাপক হানা রুথ টমসন, দীপেশ চক্রবর্তী নাটকের বিষয়বস্তু ও তার সাহিত্যিক উপাদান নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন, হানা বলেন, ‘এটাকে আপনি নাটক বলছেন কেন? আমার কাছে তো এটাকে উপন্যাস মনে হলো।’ আবার টনি বললেন, ‘আপনি নাটকের গল্প নিয়েছেন চর্যাপদ থেকে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো এখানে আপনি যে আখ্যানটা নির্মাণ করেছেন তা কি রূপক অর্থে না কি বাস্তব অর্থে? আপনি কাহ্নু-ডোম্বীর সম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন তা কি শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, নাকি ধর্মীয়?’ আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি—আমি তাদের সবার উদ্দেশ্যে বলি—বোধিদ্রুম নাটকটির পূর্ব নাম ন নৈরামণি, ১৯৯৮ সালের দিকে এই নাটকটি আমি লিখি, বহুবার এটি আবৃত্তি প্রযোজনা ও একবার মঞ্চ প্রযোজনা হিসেবে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছে, কিন্তু এত দিন কারও মুখ থেকে এই প্রশ্নগুলো শুনিনি। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো খুব প্রাসঙ্গিক। আসলে আমি চর্যার মূল পদগুলোকেই বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি এই নাটকের গল্পের ভেতর দিয়ে, কিন্তু চর্যাপদ যেহেতু একটা সময়ের ফসল, তাই সেই সময়ের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় বিরোধ, লৈঙ্গিক-বৈষম্য—সবই আমার নাটকের শরীরে স্থান নিয়েছে।
আমার নাটক পাঠ ও তা নিয়ে আলোচনার বেশ আগেই অধ্যাপক ইমেরিটাস ক্লিটন বি. সিলি অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। দুপুরের খাবার সময় তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথাও হয়েছে। এবার তাঁর মূল রচনা পাঠ। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে ‘দুই বাংলা, না দুই বাঙালি’ শিরোনামে ক্লিটন বি. সিলি বক্তৃতা শুরু করলেন। তখনো জানতাম, তাঁর বক্তৃতার অনেক অংশজুড়ে আমার নিজের লেখা নাটকের সংকলন ‘নাটকসংগ্রহ’-এর আটটি নাটক। তিনি চমৎকারভাবে খুব সংক্ষিপ্তাকারে আমার নাটক রচনার কলাকৌশল, ভাষারীতি, আখ্যানশৈলী, চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলেন, পাশাপাশি আলোচনা করলেন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের গল্প ও ভাষারীতি নিয়ে। ক্লিটনের চিত্তাকর্ষক আলোচনার ভেতর দিয়ে সেদিনের ‘দুই বাংলা’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।
পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় দুই বাংলার অনুষ্ঠান শুরু হলো। শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গের লেখক রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা। তিনি তাঁর বক্তৃতা নিজের লেখালেখি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাসের ভাষারীতি, আখ্যান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন এবং প্রশ্নোত্তরে অংশ নেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমার বক্তৃতা। আমার বক্তৃতার শুরুতে সভাপতি হিসেবে বক্তৃতা করেন মিউজিক বিভাগের অধ্যাপক ফিলিপ বোলম্যান, তিনি আমার পূর্ববর্তী সেমিনার ‘সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামালে’র পরিবেশনারীতির প্রশংসা করে আমাকে বক্তৃতা উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি আমার ব্যক্তিগত নাট্যরচনার অভিজ্ঞতায় কীভাবে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের অনুপ্রেরণা ও বিশ্বনাট্যের পুনর্নির্মাণ সম্ভব করি, সে বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করি। একই সঙ্গে আমার নাটক মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা ও নাট্যকার জীবনে গ্রাম থেকে নিগৃহীত ও বিতাড়িত হওয়ার করুণ ইতিহাস বর্ণনা করি।
আমার বক্তৃতার পর অধ্যাপক টনি কে স্টুয়ার্ট বাংলা পুঁথি ইবলিশনামার ওপর বক্তৃতা দেন।
এরপর ভিন্নভাষীর মধ্যে বাংলা ভাষাচর্চার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ফরাসি অধ্যাপক ফিলিপ বেনুয়া ও জার্মান অধ্যাপক হানা রুথ টমসন। সবশেষে ক্লিটন বি. সিলির সঙ্গে গোলটেবিল আলোচনার ভেতর দিয়ে ‘দুই বাংলা’র আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু আমার কার্যক্রম ও উপস্থাপনার তখনো বাকি। কেননা, একদিকে দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মিউজিক বিভাগের এথনোমিউজিকোলজির অধ্যাপক কেলি ম্যাসন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন ৩ মে তাঁর বিভাগের মিউজিক অব এশিয়া কোর্সের একটি ক্লাসে অংশ নেওয়ার জন্য, অন্যদিকে সুদূর সিয়াটলে অধ্যাপক রিচার্ড সলোমন ১৪ মে আমার জন্য ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ডিপার্টমেন্টে একটি সেমিনার আয়োজন করেছেন। দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মিউজিক বিভাগের জন্য আমি বাংলা বুদ্ধ নাটকের ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার আবিষ্কৃত নতুন কিছু তথ্যের আলোকে বক্তৃতা দিই। মিউজিক বিভাগের ছাত্রদের সামনে সংগীত একটি অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র উপস্থাপন করি, উপস্থাপন করি এ দেশের সমতল ও পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও অবাঙালি গ্রামীণ মানুষের সৃজনশীল প্রতিভাকে এবং সংগীত-নৃত্য-নাট্যের ঐতিহ্যবাহী চর্চার হাজার বছরের ইতিহাসকে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সীমান্ত অতিক্রমী চরিত্রকে।
মিউজিক বিভাগের ক্লাসের পরের দিনগুলোতে অধ্যাপক থিবো দুবের ও আমি মিলে মাত্র তিন দিনের মধ্যে কুমিল্লার রামমালা গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আঠারো শতকের হাতে লেখা একটি দুর্লভ পান্ডুলিপি রূপগোস্বামী রচিত ‘শ্রীমুকুন্দমুক্তাবলী’র পাঠোদ্ধার করি এবং বাংলা একাডেমীতে সংরক্ষিত আলাওল রচিত ‘সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল’-এর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সম্পাদনার কাজ শুরু করি।
এর মধ্যে আমার সময় হয়ে আসে সিয়াটলে যাওয়ার। ১২ মে আমি শিকাগো থেকে সিয়াটলে রওনা দিই। সেখানে বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান অধ্যাপক রিচার্ড সলোমন। তিনি বিখ্যাত লালন গবেষক ও অনুবাদক প্রয়াত অধ্যাপক ক্যারল সলোমনের স্বামী এবং ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক। বহুদিন ধরে ভাবুক দরদি জাহিদ নজরুল ও অধ্যাপক নন্দিনী আবেদীনের মধ্যস্থতায় ক্যারল ও রিচার্ডের এই বাড়িতে আমার আসার কথা চলছিল। উদ্দেশ্য একটাই, এই বাড়িতেই ক্যারলের লালন গবেষণার সব কাজ সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু ক্যারলের আকস্মিক মৃত্যুতে এত দিনেও তাঁর প্রধান কাজ লালনের গানের সঠিক অনুবাদ ও পাঠ প্রকাশিত হয়নি। আমাদের লক্ষ ক্যারলের অনুবাদ ও গবেষণাকর্ম যথাযথভাবে প্রকাশ করা। আমি সিয়াটলে ক্যারলের বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই অধ্যাপক রিচার্ডকে বলি, আমার প্রথম কাজ ক্যারলের সমাধির পাশে গিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়ে আসা। তাই হলো, বিভিন্ন রঙের কিছু ফুল নিয়ে আমরা ক্যারলের সমাধিতে দিয়ে তাঁকে সম্মান জানাই। এরপর ঘরে এসে ক্যারলের চিঠিপত্র থেকে শুরু করে ফিল্ডওয়ার্ক নোট, অনুবাদ গান, দুর্লভ পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ি। একজন গবেষক এত নিবেদিত হতে পারেন! অথচ জীবদ্দশায় তাঁর কোনো কিছুই প্রকাশ পায়নি বলে দুঃখ হয়। আমি দায়িত্ব নিতে চাই ক্যারলের সব প্রকাশনার জন্য একবাক্যে আমাকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করেন অধ্যাপক রিচার্ড সলোমন। বাংলাদেশের সাধুগুরুদের পক্ষ থেকে তাই তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
আমার আগমন উপলক্ষে রিচার্ড সলোমন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে যখন একটি সেমিনারের আয়োজন করলেন তখন আমি তাঁর শিরোনাম ঠিক করলাম: ‘ক্যারল সলোমনের ফিল্ডওয়ার্ক: বাংলাদেশের গ্রামীণ কবি-সাধকদের কর্তৃক সম্মানিত হবার বিবরণ’। সেমিনারে আমি ক্যারলের ফিল্ডওয়ার্ক নিয়ে কবি বিজয় সরকার রচিত একটি কবিতা, কবিগানের আসরে ফরিদপুরের কবি নারায়ণ বালার একটি আসরের ভিডিও (যেখানে তিনি ক্যারলের ফিল্ডওয়ার্ক সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দিয়েছেন) এবং লালনপন্থী সাধক খোদাবক্স শাহ ও কবি বিজয় সরকারকে লিখিত ক্যারলের হাতে লেখা দুটি চিঠি প্রদর্শনের মাধ্যমে আমার বক্তৃতা দিই। সেমিনারের শেষে বাংলা ও ইংরেজিতে লালনের সংগীত পরিবেশন করেন কিথ চান্টু। সেমিনারে এশিয়ান বিভাগসহ এথনোমিউজিকোলজি, সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী যোগ দিয়ে ক্যারলের প্রতি যে ভক্তি প্রদর্শন করেছেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সেদিন ক্যারলের একমাত্র সন্তান জেসিও উপস্থিত ছিলেন এবং আমার বক্তৃতার পর আবেগ আপ্লুত জেসি চোখের জল গোপন করতে পারেন না, তাঁর ওই কান্নাজড়ানো কণ্ঠেই মা ক্যারলের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন, আর কৃতজ্ঞতা জানালেন বাংলাদেশের লোককবিদের।
জেসির কণ্ঠস্বরের ভেতর দিয়ে আমি যেন ক্যারলের কণ্ঠস্বরই শুনতে পেলাম। ধন্য মায়ের ছেলে, ধন্য বলি বাংলাদেশের মাটিসংলগ্ন কবি-গায়ক-সাধকদের, আর প্রাচীন-মধ্যযুগের পথ পাড়ি দিয়ে সাম্প্রতিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিশ্ববিস্মৃত সব চেষ্টা ও সাধনার। কেননা, সুদূর আমেরিকার ভুবনবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও চর্চিত হচ্ছে বাংলা ভাষার মহিমার অধ্যায়। বলা যায়, আমি কিছু সময়ের জন্য এর সাক্ষী হয়েছিলাম মাত্র। জয় বঙ্গমাতা!

No comments

Powered by Blogger.