যানজট নিরসন-বিবেচনার জন্য একটি প্রস্তাব by মোহাম্মদ নজরুল হোসেন

সামপ্রতিক সময়ে আমাদের অতি প্রিয় ঢাকা নগরের যানজট অসহনীয় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। নানা পরিকল্পনা নেওয়া সত্ত্বেও এই যানজটকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে ঢাকা মহানগরকে পরিত্যক্ত শহর বা বসবাসের অনুপযোগী মৃতের শহর বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।


কিন্তু কেন? সন্দেহ নেই যে অনেক চিত্তাকর্ষক, আধুনিক পরিকল্পনা কিংবা অবাস্তব ধারণার নামে পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি সম্ভব হয়নি। বরং দিনের পর দিন যানজট বেড়েই চলছে। গত ২০ বছরে ঢাকা শহরে নতুন সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। অথচ তার বিপরীতে প্রতিদিন নগরের রাস্তায় নিত্যনতুন গাড়ি নামছে। এত স্বল্প আয়তনের নগরে বিপুলসংখ্যক গাড়ির ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গড়ে যেখানে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৬৫টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে, অথচ এক ইঞ্চি রাস্তাও বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে দুঃসহ, অসহনীয় ও অনতিক্রান্ত যানজট। সন্দেহ নেই যে ঢাকা মহানগরের এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে যানজট। এই যানজট থেকে উত্তরণের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী ব্যক্তিরা অনেক পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে উপস্থাপন করেছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন সেবা সংস্থার পারস্পরিক সমন্বয়হীনতাকে এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই যে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা কিংবা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে, তাতে করে সমস্যাটির সমাধান তো হচ্ছেই না, বরং সমস্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অনেকটা সেই প্রবাদের মতো, ‘যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্পান্ন’। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জনগণকে ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করে একটিমাত্র নির্বাহী আদেশে ঢাকা মহানগরের যানজটকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব। আর এ জন্য সরকারের কোনো অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করতে হবে না। অর্থাৎ সরকার জনগণকে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, দেশপ্রেম ও ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করে এই যানজটকে নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করতে পারে।
মানব আচরণকে যৌথ ত্যাগ স্বীকারের পথে পরিচালনা করলে এটি সম্ভব। আমরা যদি ঢাকা শহরের একটি ব্যস্ততম সড়ক কারওয়ান বাজারের অফিসকালীন গাড়ির অবস্থা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব, এ সময়ে এই সড়কে অসংখ্য প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস-মিনিবাস ও পাজেরো গাড়ি চলাচল করে। রাস্তায় যদি আমরা গাড়ির উপস্থিতি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারি, সে ক্ষেত্রে অসহনীয় যানজট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু কীভাবে? খুব সহজে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। প্রাইভেট কারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বিআরটিএর পরিসংখ্যান ও তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে ক, খ, গ, ঘ এই চারটি সিরিজের প্রাইভেট কার প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। প্রতিটি সিরিজে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার গাড়ি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে শুধু নির্বাহী আদেশে সপ্তাহের এক দিন একটি সুনির্দিষ্ট সিরিজের গাড়ি বন্ধ রাখত, তাহলে যানজট অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আনা যেত। অর্থাৎ ‘ক’ সিরিজের প্রাইভেট কার যদি রোববার চলাচল বন্ধ থাকে, সে ক্ষেত্রে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের যানজট কমে যেত। একইভাবে সোমবারে ‘খ’ সিরিজ, মঙ্গলবার; ‘গ’ সিরিজ, বুধবার; ‘ঘ’ সিরিজের প্রাইভেট কার চলাচল বন্ধ রাখা গেলে অসহনীয় যানজটকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা সম্ভব হতো। যেকোনো সিরিজের গাড়ি বন্ধ রাখার সময়সীমা হতো সকাল ছয়টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সিরিজের গাড়ির মালিককে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে সচেতন নাগরিক সমাজ এবং সরকার ত্যাগ স্বীকারের অনুরোধ জানাবে। আশা করি, প্রাইভেট কারের মালিকেরা দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এবং একই সঙ্গে ঢাকা মহানগরের অসহনীয় যানজটকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা দেবেন। অন্তত সপ্তাহের এক দিন তাঁরা সরকারের আহ্বানে এই অনুরোধটুকু রক্ষা করবেন।
আমাদের আলোচনায় আমরা ‘ক’ ‘খ’ ‘গ’ ‘ঘ’ সিরিজের গাড়িগুলো যথাক্রমে রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধবার বন্ধ রাখার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের হাতে থাকে সপ্তাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার ‘চ’ সিরিজের মাইক্রোবাস এবং ‘অ’ সিরিজের পাজেরো গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসও যানজটকে সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। বাই রোটেশনে আমরা যদি এভাবে প্রতিটি কার্যদিবসে জনগণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দেশপ্রেম ও ভ্রাতৃত্ববোধের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন সিরিজের প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও পাজেরো চলাচল বন্ধ রাখতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঢাকা মহানগরের দুঃসহ যানজট থেকে উত্তরণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটি অতিরিক্ত টাকা ব্যয় না করেও এ সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব। আমরা সবাই যদি বৃহৎ ত্যাগের মানসিকতা, দেশপ্রেমের নিরিখে পরিচালিত হই, তাহলে অবশ্যই অসহনীয় যানজট থেকে উত্তরণ সম্ভব। আশা করি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সচেতন নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবাই প্রস্তাবটি ভেবে দেখবেন।
মোহাম্মদ নজরুল হোসেন: পুলিশ সুপার, লক্ষ্মীপুর।
nazrul.hossain@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.