আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-১১)-সিনেমাই ছিল বিনোদনের মাধ্যম by আলী যাকের

অভয় দাস লেনে আমার খালার বাসার পেছনে একটা ঘাট বাঁধানো পুকুর ছিল। সেখানে আমরা সাঁতার কাটতাম দাপাদাপি করে। আমার বোন কুষ্টিয়ায় থাকতে সাঁতার শেখেনি_সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ওই পুকুরের মধ্যখানে শেওলা আটকানোর জন্য বাঁশের একটা চৌকোনো ফ্রেম করা ছিল।


হঠাৎ একদিন তার ইচ্ছে হলো, ওই ফ্রেম পর্যন্ত তাকে পিঠে করে সাঁতরে যেতে হবে। আমিও পিছপা নই। বললাম, 'চলো'। ওকে পিঠে করে বাঁশের ফ্রেম পর্যন্ত পেঁৗছানোর আগেই আমার মনে হলো আমি ডুবে যাব। তবুও শরীরের প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে সাঁতার কেটে পেঁৗছলাম অভীষ্ট লক্ষ্যে। কিন্তু ওকে পিঠে নিয়ে ঘাটে ফিরে যাওয়ার সাধ্য আমার ছিল না। এদিকে ও বাঁশের ওপর ভর দিয়ে পানিতে ভাসার চেষ্টা করছে দাপাদাপি করে। আর আমি তারস্বরে চেঁচাচ্ছি। আমাদের চেঁচামেচিতে ভাইয়ার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তিনি এসে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে এসে দিব্যি ঝুনুকে পিঠে তুলে নিয়ে ঘাটে পেঁৗছে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে আমাদের দুই ভাইবোনের অকালপক্বতার জন্য ভাইয়ার হাতে কিঞ্চিৎ উত্তম-মধ্যম খেতে হয়েছিল। অবশ্য এ তো স্বাভাবিক।
ঢাকায় তখন শহরবাসীদের জন্য সিনেমাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। বেশ কিছু সিনেমা হল ছিল ইংলিশ রোড, নবাবপুর, সদরঘাট, ইসলামপুর ও আরমানিটোলায়। তখনো গুলিস্তান সিনেমা হল হয়নি। তবে সেই জায়গাটা ডিএনফা বলে একটি অভিজাত পণ্যের বিতান ছিল। এইখানে ব্রিটানিয়া বলে একটি ছোট্ট সুন্দর সিনেমা হল ছিল। পরিবারের আমরা সবাই ডিএনফাতে আইসক্রিম খেতে যেতাম। একবার আইসক্রিম খাওয়ার পর ভাইয়ার সঙ্গে আমি এবং আমার ছোট বোন একটা ছবি দেখতে গিয়েছিলাম ওই ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে। সিনেমা হলে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে আগেই উল্লেখ করেছি। খুলনা ও কুষ্টিয়ায় দিদি আর মা ভারতীয় ছবি দেখতে যেতেন। আমি আর আমার ছোট বোন বাবার পিয়নের হাত ধরে গিয়ে হঠাৎ হাজির হতাম। আবার অল্পক্ষণের মধ্যেই আগ্রহ হারিয়ে হল থেকে ফিরে আসতাম বাড়িতে। কিন্তু ব্রিটানিয়ায় সিনেমা আমাদের মন কেড়ে নেয়। ছবিটির নাম খুব সম্ভবত ছিল 'জাঙ্গল বয়'। এতে ভারতের হায়দরাবাদের সাবু নামের এক অভিনেতা অভিনয় করেছিল। হাতির সঙ্গে তার সখ্য, অবলীলায় গাছের ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে চলে যাওয়া_এসব মন্ত্রমুগ্ধের মতো গলাধঃকরণ করেছিলাম। সাবু পরবর্তী সময়ে হলিউডের একজন নামজাদা অভিনেতা হয়েছিল বলে শুনেছি। অবশ্য তার আর কোনো ছবি আমার দেখা হয়নি। বাল্যকালের মন কখন যে কি চায় সে সম্পর্কে বলা দুরূহ। তবে জাঙ্গল বয়, টারজান অথবা কাউবয় ছবি আমরা গোগ্রাসে গিলতাম_এ কথা স্পষ্ট মনে আছে।
ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের জন্য বাজার করার জায়গা ছিল নবাবপুর, পাটুয়াটুলী ও সদরঘাট। এসব জায়গায় মায়ের সঙ্গে অনেকবার যাওয়া হয়েছে। ওই সময় ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল অতি অল্প এবং শহরকে দুই ভাগে ভাগ করে যাওয়া রেললাইনের পশ্চিম প্রান্তে রমনা এলাকা ছিল একেবারে ফাঁকা। বুদ্ধদেব বসুর 'ভাসো আমার ভেলা' অথবা ঢাকা সম্পর্কে অন্যান্য স্মৃতিচারণা পড়লে এই ছিমছাম সুন্দর ঢাকার পরিচয় পাওয়া যায়। ভাবতে অবাক লাগে যে বঙ্গভবনের পেছনে যেখানে এখন ওয়াপদা বিল্ডিং এবং অন্যান্য অফিস বিল্ডিংয়ের সমারোহ, সেখানে ছোট, ছোট ঝিলে ঘেরা বেশ কিছু খেলার মাঠ ছিল। আমাদের মতো বাচ্চাদের ক্রিকেট ম্যাচ সেখানেই হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ানোর জন্য একটি অসাধারণ জায়গা ছিল। আমরা ভাইবোনরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায়ই ওই এলাকায় চলে যেতাম। মিন্টো রোড, বেইলি রোড, পার্ক রোড_এসব রাস্তায়ও ছিল সবুজের সমারোহ। অবশ্যই এই এলাকাগুলো, আমি মনে করি, এখনো প্রায় একই রকম আছে; যদিও শাহবাগ এলাকা থেকে অনেক বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। তফাৎ কেবল এই যে যানবাহন নির্গত ধোঁয়া এ গাছগুলোর জীবনীশক্তি শেষ করে দিচ্ছে। আমরা মাঝেমধ্যে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ যেতাম। সে স্টেশনটির কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। ঢাকার প্রধান স্টেশন এখন কমলাপুরে। ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। সেখানে আমার বড় মামা রশিদ আহমেদ থাকতেন। তিনি একজন পাট বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহর থেকে এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে সেই চলি্লশের দশকে কলকাতায় ফিরেছিলেন। তিনি এক সময় কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। লেফট আউট হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলায় গোল করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ছোট রশিদ নামে। মামাবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। বড় মামা ছিলেন মায়ের পিঠাপিঠি ছোট ভাই। অতএব, তিনি উদগ্রীব হয়ে থাকতেন কবে ভাইয়ের বাড়ি যাবেন। যাওয়ার দুই দিন আগে থেকে মামার পছন্দের বিশেষ বিশেষ খাবার মা নিজের হাতে রান্না করতেন এবং আমরা জানতাম যে এসব উপাদেয় রান্নার ভাগ আমরাও পাব নারায়ণগঞ্জে গেলে। এ ছাড়া একটি ব্যাপার ছিল। বড় মামা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বিশাল একটি বাংলোতে থাকতেন। বাড়ির সামনেই নদী ঘেঁষে ছিল তাঁর বাগান। সেখানে সারা দিন আমরা খেলাধুলা করতাম।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.