শেকড়ের ডাক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জনজীবন : সরকার উদাসীন by ফরহাদ মাহমুদ

সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার যেন শেষ নেই। বিদ্যুৎ-গ্যাসের পাশাপাশি নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানির অভাবও তীব্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দরিদ্র শ্রেণী নয়, মধ্যবিত্তের জীবনেও রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে গেছে। একে তো খাবার জোটে না; তার ওপর যেটুকু জোটে তাতেও ভেজাল।


অনেক সময়ই সেই ভেজাল হয় বিষাক্ত। যেমন মাছে ফরমালিন, ফল পাকাতে কার্বাইড, মিষ্টি ও অন্যান্য রঙিন খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত রং, মুড়িতে ইউরিয়া_এমন তালিকা কম দীর্ঘ নয়। এসব খেয়ে ক্যান্সার, লিভার, কিডনি ও হার্টের রোগ বাড়ছে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা রোগ দেহে বাসা বাঁধছে। কিন্তু তারা চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবে? সরকারের স্বাস্থ্যব্যবস্থা রীতিমতো ভেঙে পড়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষমতা দেশের ৮০ শতাংশ মানুষেরই নেই। তদুপরি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চিকিৎসার মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। যানজট ও যানবাহনের সমস্যা রাজধানীর নাগরিকরা তো প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ১৫ মিনিটের পথ পেরোতে ঘণ্টাধিক সময় তো যাবেই। বাসে মুরগির খাঁচার মতো গাদাগাদি করে কিংবা বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে আসা-যাওয়ার ধকল অনেকেরই সহনীয় হয়ে গেছে। কারণ বিকল্প নেই। তার পরও চুরি, পকেটমার_এসব তো আছেই।
পরিবেশ নিয়ে মানুষের সচেতনতা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু তাতে পরিবেশ দূষণ একটুও কমছে না। বরং সচেতনতার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বেড়ে চলেছে দূষণ। ফলে সচেতন মানুষের উদ্বেগও বাড়ছে সমানতালে। তার কারণ পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিনিয়ত সেসব পরিবেশ দূষণের কুপ্রভাব জনসমক্ষে তুলে ধরছে। রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এত বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে যে সেসব নদীর পানি শোধনাগারে শোধনের পরও পান করার অযোগ্য থেকে যাচ্ছে। শোধনাগারে জীবাণুনাশ বা ময়লা কিছুটা কমানো হলেও কারখানাগুলো থেকে যে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য এসে নদীর পানিতে মিশছে, এসব শোধনাগারের প্রযুক্তি সেসব রাসায়নিক দ্রব্য শোধন করতে পারে না। ফলে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে অনেক বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নদীর পানিশোধনে যে পরিমাণ ক্লোরিন বা রাসায়নিক শোধনসামগ্রীর ব্যবহার মাত্রার চেয়ে ওয়াসাকে সাত-আট গুণ বেশি শোধনসামগ্রী ব্যবহার করতে হয়। ওয়াসার পানিতে অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ রাখলে অনেক মাছই মরে যায়। অত্যধিক ক্লোরিন সহ্য করতে পারে না। শৌখিন মাছ পালনকারীদের সেই পানি ক্লোরিনমুক্ত করার জন্য অন্য ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। মানবদেহেও তার ক্ষতিকর প্রভাব অবশ্যই পড়ে। কিন্তু মানুষ নিরুপায়। পানি ছাড়া তো কারো এক দিনও চলে না। কিন্তু ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণমুক্ত করার কী উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। এমনকি নদী দূষণমুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনাও সরকার উপেক্ষা করে চলেছে। রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আমাদের সরকারগুলোর কাছে কেন এমন গুরুত্বহীন থেকে যাচ্ছে?
বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা মহানগর পৃথিবীর অন্যতম একটি দূষিত শহর_এমন খবর আমরা আগেও দেখেছি, এখনো দেখছি। বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যে দেখা যায়, বায়ুদূষণজনিত কারণে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনাক্রমেই বাড়ছে। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও অসুখ-বিসুখের ১০ শতাংশই হয় বায়ুদূষণের কারণে। ক্রনিক ব্রংকাইটিস, পালমোনারি এমফাইসেমা, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদিও ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুতে থাকা বস্তুকণার ওপর ভিত্তি করে নানা ধরনের বিষক্রিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপকভাবে। শুধু ঢাকায় নয়, অন্যান্য বড় শহরেও দ্রুত বাড়ছে বায়ুদূষণ। আর এ জন্য প্রয়োজন এখনই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া। তা না হলে অচিরেই এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ নেবে, আর তখন তা চলে যাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাস্তার ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ গাড়ি নগরীতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ঘটিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক কিছু জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায় কিংবা রোগাক্রান্ত হয়, তার ২১ শতাংশই ঘটে বিভিন্ন রকম পরিবেশ দূষণের কারণে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক সমীক্ষায়ও বায়ুদূষণকে রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়, আমাদের শহরগুলোর বায়ুদূষণ ২০ থেকে ৮০ শতাংশ কমানো গেলে বছরে এক হাজার ২০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার জীবন বাঁচানো যেত। পাশাপাশি বছরে আট কোটি থেকে ২৩ কোটি পর্যন্ত রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এড়ানো যেত। কারণ একজন মানুষের বছরে কয়েকবার রোগাক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আর এ বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার অপরিকল্পিত বৃদ্ধি। তথা গণপরিবহনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া।
মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যাও_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে বৃদ্ধিটা হওয়া উচিত পরিকল্পিতভাবে। কারণ মানুষকে বেঁচেও থাকতে হবে। সারা পৃথিবীতে এখন মাথাপিছু কম পরিবেশ দূষণকারী বড় বড় যানবাহনের সংখ্যা বাড়িয়ে ছোট যানবাহনের সংখ্যা কমানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেন বা রেল পরিবহনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একটি ট্রেন বা মালগাড়ি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যে পরিমাণ মাল পরিবহন করতে পারে, সমপরিমাণ মাল পরিবহন করতে কয়েক হাজার ট্রাকের প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েক হাজার ট্রাক যে পরিমাণ বায়ুদূষণ করবে, সে তুলনায় একটি ডিজেলচালিত রেল ইঞ্জিন প্রায় কোনো দূষণই করবে না। বিদ্যুৎচালিত ট্রেনের দূষণ তো নেই বললেই চলে। অথচ এ দেশে প্রতিনিয়ত যেভাবে ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তা যদি রোধ করা না যায় তাহলে বড় শহরগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এখনো প্রচুর মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো গাড়ি চলতে দেখা যায়, যেগুলোর দূষণের মাত্রা তুলনামূলক অনেক বেশি। সারা দেশেই বাড়ছে ডিজেলচালিত নছিমন, করিমন-জাতীয় গাড়ির সংখ্যা, যেগুলোর ইঞ্জিন গাড়ি চালানোর জন্য তৈরিই হয়নি। এগুলোর পরিবেশ দূষণের মাত্রাও অনেক বেশি। কার্বন ডাই-অঙ্াইড তো বটেই, এগুলো থেকে সরাসরি হাইড্রোকার্বনও (জ্বালানি ঠিকমতো না পোড়ার ফলে যে অবশিষ্টাংশ বেরিয়ে আসে) নির্গত হয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাম্প্রতিক অবনতি অনেকেরই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। অথচ আমাদের আইন কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা এখনো ঢেঁকুর তুলতে এবং ভাঙা রেকর্ড বাজাতেই ব্যস্ত। সঠিক পরিসংখ্যান পেলে দেখা যাবে, দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। কমেনি অস্ত্রবাজি। খুন-ডাকাতি যে বেড়ে গেছে, তা তো প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। জঙ্গি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে বলে যাঁরা ঢেঁকুর তোলেন, তাঁদের জানা দরকার যে তাঁরা যা বলছেন, তা কতটা সত্য! জঙ্গিদের হামলা বা সহিংস তৎপরতা কমা মানে সমস্যার সমাধান নয়। এটা তাদের রণকৌশলও হতে পারে। তাদের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি যে অব্যাহত আছে, তা গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের জবানি থেকেই জানা যায়। তাদের মদদদাতারাও বহাল তবিয়তেই আছেন এবং মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। সময়-সুযোগ বুঝে অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরেকটু অস্থিতিশীল হলেই তারা আবারও মাঠে নামবে বা নামানো হবে। চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্যও খুব একটা কমেছে বলে মনে হয় না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খুনখারাবির পরিসংখ্যান সেই ইঙ্গিতই দেয়।
চলতি শীত মৌসুমে একবারই মৃদু থেকে মাঝারি একটি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল। আর তাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর কারণ শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সংগতি না থাকা মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি। ঘর-দুয়ারহীন মানুষের সংখ্যা কত তা একদিন মধ্যরাতে রাজধানীর ফুটপাতগুলো ঘুরে দেখলে সামান্য অনুমান পাওয়া যেতে পারে। শীত-গ্রীষ্ম, ঝড়-বৃষ্টিতে তারা নিরুপায় হয়ে সামান্য আশ্রয় খোঁজে। কেউ পায়, কেউ পায় না। উত্তরবঙ্গে শীতে অনেক মানুষ মারা গেছে। কারণ সেখানকার চরাঞ্চলগুলোতে মূলত দরিদ্র মানুষের বসবাস। শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো গরম কাপড় তাদের নেই। ঘর বলতে তারা যেসব ঝুপড়িতে থাকে, তার ভাঙা বেড়া হাড় কাঁপানো উত্তুরে বাতাস আটকাতে পারে না। সেনাবাহিনীর সহায়তায় এদের জন্য টিনশেড নির্মাণ করে দেওয়াটা কি খুবই কঠিন কোনো কাজ? প্রতিবছর কয়েক হাজার পরিবারের পুনর্বাসন খুব কি ব্যয়বহুল বা বোঝা হয়ে যাবে সরকারের জন্য? মনে হয় না।
আমরা বরাবরই দেখে এসেছি, হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্পে আমাদের সরকারগুলো যতটা আগ্রহী ছোটখাটো অথচ জরুরি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তারা ততটা আগ্রহী হয় না। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ নেই একই কারণে। একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্যশোধন প্রকল্প বা ইটিপির অভাবে হাজারীবাগ থেকে চামড়া কারখানাগুলো এক দশকেও স্থানান্তর করা যায়নি। অথচ এসব কারখানা স্থানান্তরের জন্য সাভারে জমি অধিগ্রহণ করে ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সরকারি দলের নেতানেত্রীরা ক্ষমতায় আসার আগে ইশতেহারে, বক্তৃতায় গরিবের জন্য যে পরিমাণ মায়াকান্না করে, ক্ষমতায় আসার পর যদি তার কিয়দংশও টিকে থাকত, তাহলে মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা কোনোক্রমেই এত প্রবল হতো না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশের মানুষ বারবারই তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে আসছে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.