কলকাতা বইমেলা এবং পিকনিক স্পট by সুব্রত আচার্য্য

বই আর খাবারে জমে উঠছে 'কলকাতা পুস্তক মেলা', যার কথ্য নাম 'কলকাতা বইমেলা'। গত ৩০ জানুয়ারি বইমেলার প্রথম ছুটির দিনে উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে মেলায়। ধুলাবিহীন মেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আয়োজক ওয়েস্ট বেঙ্গল বুক সেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ড। খানিকটা হলেও ওই প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছে গিল্ড।


নাসিকায় ধুলার সন্ত্রাস রুখতে মেলায় পায়ে হাঁটার পুরো পথটাই কংক্রিটের পাটাতনে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য তাতেও হাজার হাজার পায়ের সঙ্গে বাইরের 'অতিথি ধুলা' এসে বইমেলার চিরাচরিত ধূলিময়তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে বইপ্রেমীদের।
মেলায় বাংলাদেশের জাদুঘরের আদলে প্যাভিলিয়নটি নানা কারণে অন্য যেকোনো বারের তুলনায় এবার আলোচিত-সমালোচিত। এর মধ্যে প্যাভিলিয়ন ঘেঁষে ফুডপার্ক এবং প্যাভিলিয়নের ভেতর দিশাহীন স্টল বিন্যাস মেলায় আগতদের মনে অনেক রঙের প্রশ্নই আঁকছে।
প্যাভিলিয়নের 'এঙ্টি' এবং 'এন্ট্রান্স' দুই দিকেই ফুডপার্কে ক্ষুধার্ত বইপ্রেমীদের দৌরাত্ম্য। দূর থেকে দেখে ওটাকে বইয়ের বাজার বলে মনে হওয়াটা মুশকিল। কিন্তু এমন অবস্থা শুধু যে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সামনে, তা নয়। মেলার আঁকেবাঁকে কয়েক কদম হাঁটলেই গিল্ডের সৌজন্যে স্টলের ফাঁকফোকরে চায়নিজ, ফুচকা কিংবা আইসক্রিমের দোকান মিলছে।
স্বাভাবিকভাবেই ভোজনরসিক বাঙালির সামনে 'বই', না 'খাওয়া'_দুটি দ্রষ্টব্য রাখা হলে, বুকে হাত দিয়ে বলার উপায় নেই, বাঙালি খাওয়ার দিকেই দৌড়াবে না। ফলে ৩৫তম কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলায় যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। এই ইস্যুতে বিতর্ক উস্কে দিয়ে বলা যায়, এবারকার কলকাতা পুস্তক মেলা আদৌ কি 'বইমেলা', নাকি 'পিকনিক স্পট'। তবে যত্রতত্র খাওয়ার দোকান ছাড়া বইমেলা সার্বিকভাবে সফল না বিফল, তা অবশ্য এখনো বলার সময় আসেনি। খাতা-কলমে ২৫ জানুয়ারি কলকাতা বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও বইপ্রেমীদের জন্য পরদিন ২৬ তারিখ খুলে দেওয়া হয় মেলার দরজা। সে হিসেবে রবিবার ছিল মেলার সপ্তম দিন। সেদিন গিল্ডের হিসাব অনুযায়ী, মেলায় প্রায় দুই লাখ মানুষ এসেছিল। যত মানুষ এসেছিল বই কিনতে, তার চেয়েও বেশি মানুষ এসেছিল বোধ হয় বই নাড়াচাড়া করে দেখতে কিংবা বইমেলায় সময় কাটাতে। ব্যঙ্গ করে বললে, বইমেলায় পালানো শীতের বিকেলে পরিবার নিয়ে আধা-পিকনিক করতে।
এবার বইমেলায় নতুন কী বই এসেছে_বাংলাদেশের একুশে বইমেলার মতো এখানে প্রতিদিন এ রকম নির্দিষ্ট করে হিসাব রাখা হয় না। এককথায় বলতে গেলে, বই ক্রেতাকে স্টলে স্টলে ঘুরে খুঁজে বের করতে হয় সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ-নবনীতাদেব সেনের কী বই এবার প্রকাশিত হলো। তবে এ কাজটা নতুন বইমেলামুখী হওয়াদের পক্ষে মোটেই সহজ নয়, যতটা সহজ অভিজ্ঞ বইপ্রেমী কিংবা ক্রেতাদের কাছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, সুনীল-শীর্ষেন্দুর মতো লেখকরা কয়েক বছর ধরে যতটা না নিজেদের বই প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত দেখা যায় মেলায় নতুন লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে এবার সরকারি-বেসরকারি প্রকাশনী মিলিয়ে ২৬টি সংস্থা তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসেছে। বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্টলে শুরুর দিন থেকেই ভিড় দেখা গেছে। তবে ছুটির দিনগুলোতে বিক্রেতারা হিমশিম খাচ্ছেন।
বাংলা একাডেমীর বানান অভিধান বিকোচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। শিল্পকলা একাডেমীর স্টলে দাঁড়িয়ে কলকাতার বইপ্রেমী কিনছেন কামাল লোহানীর 'ঢাকা ১৯৪৮-১৯৭১' বইটি। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক রেজাউদ্দিন স্টালিন জানান, শিল্পভিত্তিক গবেষণামূলক বইয়ের চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিল্পকলা একাডেমী বিভিন্ন বই প্রকাশ করে থাকে। আর কলকাতার মানুষও এসব বইয়ের প্রতি দারুণ অনুরক্ত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত 'বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ইতিহাস' বইটি অনেকের নজর কাড়ছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে 'দ্য ইসলামিক থ্রেট' বইটি বইপ্রেমীদের ভালো লাগতেই হবে।
সরকারি ওই প্রকাশনা সংস্থাটির উপ-গ্রন্থাগারিক ফরিদ উদ্দিনের ভাষায়, 'প্রথম দিন থেকেই স্টলে ভিড়। কেনার চেয়ে অনেকে বই নেড়েচেড়ে গন্ধ শুঁকছেন।' বাংলাদেশের স্টলে আহমেদ পাবলিকেশন্সের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের 'একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি'। ওই স্টলের বিক্রেতা জানান, 'বইটি ঢাকার একুশে বইমেলায় প্রকাশ হওয়ার আগেই কলকাতায় প্রকাশ করা হয়েছে।' অবসরের স্টলে দেখা গেছে 'ঢাকাই রান্না' কিংবা হিমু চরিত্রের বইগুলো। পাওয়া যাচ্ছে অরুন্ধতী রায়ের 'দ্য গড অফ স্মল থিকস' কিংবা রোহিন্ত মিস্ত্রির 'সাচ এ লং জার্নি'র মতো সেরা লেখাগুলো।
বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আনন্দ কম্পিউটার্সের স্টলেও ভিড় ছিল। কারণ সেখানে মাত্র ১০০ টাকায় মিলছে উইন্ডোজ সেভেনে অপারেটিং সিস্টেমে চালানোর মতো বিজয় সফটওয়্যার। স্টলের বিক্রেতা হায়দার হোসেনের আক্ষেপ, বিশ্বের জনপ্রিয় বাংলা সফটওয়্যার হওয়া সত্ত্বেও কলকাতায় এটা তেমন জনপ্রিয় হতে পারছে না। অথচ এখানে যেসব বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ইউজার-ফ্রেন্ডলি নয়। 'গাংচিল'-এর স্টলে আকিমুন রহমানের লেখা 'পৌরাণিক পুুরুষ' বইটির চাহিদাও প্রচুর।
কলকাতা বইমেলায় এবার ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম, চীন, মেঙ্েিকা, স্পেন, কিউবা ও ব্রাজিল অংশ নিচ্ছে। মেলার থিম কান্ট্রি আমেরিকা। স্বাভাবিকভাবেই এবার মেলায় বিভিন্নভাবে এই দেশটিকে প্রজেক্ট করা হয়েছে। যেমন_ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হাউসের আদলে তৈরি করা হয়েছে মার্কিন প্যাভিলিয়ন। বই কেনার চেয়ে ওই প্যাভিলিয়ন দেখার ভিড় সামলানো দায় হয়ে পড়ছে নিরাপত্তারক্ষীদের।
কলকাতার বইমেলায় এবার সব মিলিয়ে ৫২২ স্টল। এর মধ্যে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল রয়েছে ২০৫টি। এবার মেলায় বিদ্যুৎ চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে। ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, নানা কারণে মানুষ এবারকার বইমেলা মনে রাখবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ধুলাবিহীন এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পরিষেবা। এবার বইমেলার কথা প্রকৃত বইপ্রেমীরা ঠিক মনে রাখবেন। কারণ বইয়ের বাজারে যেভাবে বিদেশি খাদ্যের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে, আর রবিবার রাতের একটু দমকা বাতাসেই যেভাবে বইমেলার মূল গেটটা ভেঙে পড়ল, ভাগ্য ভালো ওটা সোম কিংবা মঙ্গলবার দিনের বেলায় ভেঙে পড়েনি। তাহলে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটত।
এমনিতেই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বইমেলার উদ্বোধন করতে এসে পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতাইয়ের গণহত্যা নিয়ে অতিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া মন্তব্যে বেজায় বিব্রত হয়েছিলেন। শুরু থেকেই এবারকার বইমেলা বড় বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। মেলা চলবে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর ওই সময়টা পর্যন্ত বইমেলা ভালোভাবে কাটুক। গত ৩৪ বছরে হয়ে ওঠা কলকাতার প্রাণের এই মেলা নিয়ে সমালোচকরা সে প্রত্যাশাই করবেন।

লেখক : কালের কণ্ঠের কলকাতা প্রতিনিধি
subrata.acharjee@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.