আশুলিয়ায় বেশির ভাগ শ্রমিক কাজে ফিরেছে-'ন্যায্য দাবি করছি গার্মেন্স বন্ধ হউক চাই নাই' by এস এম আজাদ

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৮টা। আশুলিয়া-বাইপাইল সড়কে 'স্বাভাবিক' ব্যস্ততা। দল বেঁধে কর্মীরা কাজে যোগ দিতে যাচ্ছেন। ঢুকছেন কর্মস্থল তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয়। জামগড়া বাজার এলাকায় কথা হলো একটি দলের দুজনের সঙ্গে।


শামসুন্নাহার ও সমিরুন্নেছা- দুজনই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন এনবয় গ্রুপের গার্মেন্টে। 'ভয়ে আছিলাম, কী হয়! গার্মেন্স (গার্মেন্ট) খোলব শুইনাই ভালো লাগছে। আমরা তো কাজই করতে চাই।' কাজে আসার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শামসুন্নাহারের হাসিমুখে জবাব ছিল এটাই। সমিরুন্নেছা বলেন, 'চাইর (চার) দিন আমাগো মিল বন্ধ আছিল। রাতে চিন্তায় ঘুমাইতেও পারি নাই। সংসার কীভাবে চলব? ঘরভাড়া, খাবার খরচ...গ্রামে কেমনে ট্যাকা পাঠামু? আমরা ন্যায্য দাবি করছি, কিন্তু গার্মেন্স বন্ধ হউক- এইটা চাই নাই।' টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন শ তৈরি পোশাক কারখানা খুলেছে। বিভিন্ন কারখানার বেশির ভাগ কর্মী কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল কোনো রকম উত্তেজনা না দেখা গেলেও পুলিশ, আর্মড পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও র‌্যাবের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
আশুলিয়ায় কর্মচাঞ্চল্য অনেকটা ফিরলেও আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় কি না তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে। শ্রমিকরা চিন্তিত, কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তাঁদের বেতন-মজুরি কেটে রাখা হবে কি না? কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না এবং তাঁদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি বাস্তবায়িত হবে কি না? বেশ কিছু কর্মী এ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।
ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আশুলিয়ার গার্মেন্টগুলোতে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কর্মী গতকাল কাজে যোগ দিয়েছেন। কাজের পরিবেশও ছিল স্বাভাবিক। শনিবার থেকে শতভাগ শ্রমিক কাজে যোগ দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ৮টার মধ্যেই আশুলিয়া বাজার, ইটখোলা, তৈয়বপুর, ঘোষবাগ, শিমুলতলা, জিরাবো বাজার, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, জামগড়া, বাংলাবাজার, পিয়ারপুর, নাইটিংগেল মোড়, বগাবাড়ী, ইউনিক, পুকুরপার, বাইপালসহ আশপাশের প্রায় সাড়ে ৩০০ কারখানায় কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা। গতকাল সকাল ও দুপুরে কাজ চলার সময় কোনো শ্রমিককে রাস্তায় দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এ অঞ্চলে কারখানার শ্রমিকসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। তবে গতকাল কোনো কারখানাতেই শতভাগ কর্মী উপস্থিতি ছিল না।
জামগড়ায় শারমিন গ্রুপের এএম ডিজাইনের কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আসলাম বলেন, 'অনেক কর্মী বন্ধ পেয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। তাই উপস্থিতি কম। তবে শনিবার থেকে সবাই আসবে।' একই কারখানার অপারেটর রেখা ও রাবেয়া বলেন, 'আমরা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছি। সারা মাস ওভারটাইম করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে সাত হাজার টাকাও হয় না। বাড়িভাড়া ও সংসারের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাই। এমনে বাঁচা যায়?' চার দিন বন্ধ থাকায় ওই সময়ের বেতন-ভাতা কেটে রাখা হবে কি না, এমন আশঙ্কায় আছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে এ কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউ কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। জিরাবোর আইরিশ ফ্যাশন কারখানার নিটিংম্যান আবু তাহের বলেন, 'বেতন বাড়ানোর লইগাই তো এত কিছু। এহানে অন্য কিছু নাই। থাকলেও আমরা জানি না।' আলাপকালে কর্মীরা জানান, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের কথা তাঁরাও শুনেছেন। কোনো গোষ্ঠী বা কোনো দেশ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় উসকানি দিতে পারে। তবে সাধারণ কর্মীরা এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। কিছুদিন ধরে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবির প্রসঙ্গেই সব কারখানার কর্মীরা একাট্টা হয়েছেন বলে দাবি কর্মীদের।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় চার দিনের বন্ধ এবং কিছুদিনের অস্বাভাবিক অবস্থার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে মনে করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। মেঘনা গার্মেন্টের সহকারী ব্যবস্থাপক গোলাম ফারুক বলেন, 'শনিবার থেকে সবাই কাজে যোগদান করলে বন্ধ থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।' হা-মীম গ্রুপের ট্রাউজার লাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবু নাসিম মিয়া বলেন, 'অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মীরা কাজে যোগ দিয়েছেন। সব কিছু স্বাভাবিক। চার দিনে সব কারখানারই ক্ষতি হয়েছে। তবে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব আমরা। শ্রমিকরাও চেষ্টা করবেন। কারণ এটি তাঁদের কর্মস্থল।'
আশুলিয়ার কারখানায় কর্মরত কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারী বসবাস করেন আশপাশের এলাকায়ই। তাঁদের ভাড়া বাসার মালিক এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কারখানা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছিলেন তাঁরা। জামগড়া বাজার এলাকার মুদি দোকানদার মোশারফ হোসেন বলেন, 'কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব টেনশনে পড়েছিলাম। আমার সব কাস্টমারই গার্মেন্টে চাকরি করে। হেরা বেতন না পাইলে, চাকরি না থাকলে টাকা দেব কিভাবে?' কয়েকজন ব্যবসায়ী ও বাড়িওয়ালাও এ রকম কথা বলেন।
অন্যদিকে গতকাল সকাল থেকেই আশুলিয়া থেকে বাইপাইলের অন্তত ২০টি পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ, আর্মড পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন ছিল। জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে এবং জিরাবো এলাকায় অবস্থান নেন র‌্যাব সদস্যরা। পুলিশের জলকামানের গাড়ি, আর্মড পারসোনেল ক্যারিয়ারসহ (এপিসি) বড় কিছু গাড়ি রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়। শিল্প পুলিশের পোস্টগুলোতে ছিল সদস্যদের সতর্ক অবস্থান।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, 'সকাল ৮টার আগেই শ্রমিকরা শান্তভাবে কারখানায় যোগ দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। তবে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়েছে।'
প্রসঙ্গত, বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভে গত ১১ জুন থেকে অস্থিরতা শুরু হয় আশুলিয়ার শিল্প এলাকায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত শনিবার আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। এতে রবিবার থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। গত বুধবার শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে এক বৈঠকে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা কারখানা খুলে দিতে সম্মত হন।

No comments

Powered by Blogger.