মত দ্বিমত-সুদের হার বেঁধে দেওয়া কতটা যৌক্তিক by সাজ্জাদ জহির

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। বিতর্ক রয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনে এর কার্যকারিতা নিয়েও। সরকার ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ২৭ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ক্ষুদ্রঋণ তথা দারিদ্র্য বিমোচনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, সে সম্পর্কে দুজন অর্থনীতিবিদের লেখা প্রকাশ করা হলো


সবাই স্বীকার করেন, বাংলাদেশে এনজিও ও ক্ষুদ্রঋণ খাতের বিকাশ পরিচ্ছন্ন আইনি পথে চলেনি। আইনি তদারকি না থাকায় এই খাত বিকাশের সুযোগ পেয়েছিল। অনিয়মের দুটো দিকের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। একদিকে নিয়মশৃঙ্খলার অনুপস্থিতিতে দূরবর্তী স্থানে ঋণ সরবরাহের উদ্ভাবনী ব্যবস্থা প্রসারের সুযোগ ঘটে; অন্যদিকে তদারকির অভাবে সঞ্চয়ের নামে গরিবের অর্থ আত্মসাতের দৃষ্টান্তও রয়েছে। তবে সহজলভ্য অর্থে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যই হোক, আর ঋণব্যবসার কারণেই হোক, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় এ দেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এমনকি অর্জিত পুঁজি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশাল আকার ধারণ করে অন্যান্য বাণিজ্যিক অঙ্গনে প্রসারিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আন্তর্জাতিক রূপও নিয়েছে।
ক্ষুদঋণের উল্লিখিত বিকাশধারায় কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান কি কেবলই দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে? যদি দারিদ্র্য বিমোচনই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ‘মাত্রাতিরিক্ত’ হওয়া উচিত কি? নাকি সর্বোচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া উচিত?
দেশে ইতিমধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বাজারের ব্যবস্থাপনা নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে দুটো বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। একটি হলো, ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া; অন্যটি হলো, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রামীণ বা আঞ্চলিক ব্যাংকে উত্তরণ ঘটানোর ক্ষেত্র তৈরি করা। অনেকে মনে করেন, দ্বিতীয় প্রস্তাবটি কার্যকর হলে এসব সংস্থা আইনানুগভাবে জামানত নিয়ে মূলধনের সংকট মেটাতে পারে। এর বিপরীতে প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবসার প্রসার ঘটানোর কথা কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা জোরেশোরে প্রচার করে। তাদের মতে, ক্ষুদ্রঋণ কর্মকাণ্ড বিকশিত হয়ে একপর্যায়ে মূল বাণিজ্যিক ব্যাংকিং ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে।
এতে কোনো দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই যে ঋণ প্রদান করা অর্থনীতির ভাষায় একধরনের সেবা, যা সরবরাহ করতে খরচ লাগে এবং যেটা পাওয়ার জন্য ঋণগ্রহীতা দাম দিতে আগ্রহী। অর্থাৎ, সুদ একটি বিশেষ সেবার দাম। কোনো কিছুর দাম নিয়ে কথা উঠলেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন, আমরা সমধর্মী সেবার কথা বলছি এবং সেবার তারতম্যের সঙ্গে দামেরও হেরফের হতে পারে। তাই জোর করে দুটো ভিন্নধর্মী সেবা একই দামে বাঁধার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কোনো বাজারে দাম বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন কেন হয় এবং তা কীভাবে কার্যকর করা উচিত, সে ব্যাপারে সাধারণ যেসব ধ্যান-ধারণা রয়েছে, তা ঋণের বাজারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সনাতনী বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড যেভাবে অফিসকেন্দ্রিক, ক্ষুদ্রঋণ তা নয়। ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতার দোরগোড়ায় ঋণের অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রাথমিক দলগঠন, ঋণের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং সপ্তাহভিত্তিক ঋণ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় গ্রহীতা পরিবারের নানাবিধ সামাজিক তথ্যের সঙ্গে পরিচিতি আবশ্যক। গোষ্ঠী পর্যায়ে দুর্গতি এলে সদস্যদের পাশে দাঁড়ানোর রীতিও রয়েছে। এসবের কারণে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় ঋণসেবা যত সহজে অন্য পাঁচটি সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে (যেমন—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি), তা সনাতনী ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বাংলাদেশে তিন ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক আছে—সরকারি, দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বিদেশি। তিন ধরনের ব্যাংকের আমানত ও ঋণ সুদের হারে বেশ পার্থক্য লক্ষণীয়। এদের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গ্রাম পর্যায়ে স্বল্প শিক্ষিত ও স্বল্প ঋণে আগ্রহী মানুষের দোরগোড়ায় ঋণ পৌঁছে দিতে গিয়ে অনেক বেশি (সেবামাশুল বাবদ) খরচ করে। এদের মূলধনের কিছুটা সদস্য সঞ্চয় থেকে আসে, কিছু আসে স্বল্প সুদে পিকেএসএফের কাছ থেকে এবং অনেকে অধিক সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেও ঋণ নেয়।
অর্থাৎ, খরচের হেরফের রয়েছে এবং একটি খরচের ওপর নির্দিষ্ট মার্জিন ধরে সুদের হার বেঁধে দেওয়ার যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ। উপরন্তু, সপ্তাহভিত্তিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কেউ ৪০ সপ্তাহ, কেউ বা ৩৭ সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়। সময় অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভিন্নধর্মী শিথিলতা দেখাতে পারে। ঋণ দেওয়ার সময় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে যে কর্তন হয়, সে ক্ষেত্রেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। এসবই বছরভিত্তিক কার্যকর সুদের হার নির্ণয়ে জটিলতার উদ্ভব ঘটায়।
আবার সনাতনী ব্যাংকিং খাতেও বিবিধ সেবামাশুলের বাইরে নানাবিধ আর্থিক পণ্য বা সেবার নামে বিভিন্ন ধরনের ঋণের প্রচলন দেখা যায়, যেসবের অন্তর্নিহিত বার্ষিক সুদের হার এক না-ও হতে পারে। এসব জানার পরও ক্ষুদ্রঋণের বছরভিত্তিক সুদের হার বেঁধে দেওয়া বেশ দুঃসাহসিক উদ্যোগ (!), যা এই খাতের বিকাশে বিকৃতি আনতে পারে।
সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, বার্ষিক ভিত্তিতে সুদের হার সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখন যদি ঋণ সরবরাহকারী কম খরচে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে এবং জোগানের তুলনায় চাহিদার মাত্রা কম হওয়ায় বাজারে সুদের হার ২৭ শতাংশের কম হয়, তাহলে হয়তো সমস্যা হবে না। যদি চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে (অথবা মূলধন বা সেবাদান খরচ বেশি হওয়ার কারণে) বাজারে নির্ণীত সুদের হার ২৭ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ২৭ শতাংশ সীমা মানতে গিয়ে লাভ থেকে কিছুটা বঞ্চিত হবে এবং সার্বিক সরবরাহে আপেক্ষিক ঘাটতি দেখা দেবে। অথচ ঋণগ্রহীতা বেশি সুদ দিতে প্রস্তুত থাকায় ব্যক্তিপর্যায়ে নিয়মবহির্ভূত লেনদেনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না করে সর্বোচ্চ দাম বাঁধার রীতি ব্যক্তিপর্যায়ে অবৈধ আয়ের পথ উন্মুক্ত এবং প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে পুঁজি গড়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। শেষোক্ত বক্তব্য সাধারণভাবে বিনিময়যোগ্য সব পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
দরিদ্র জনসাধারণের হাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া নিশ্চিত করতে পারলে তা দারিদ্র্য বিমোচনের পথ সুগম করে। তাই সুদের হার কমানো বা বেঁধে দেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠে। এই আবেগী যুক্তির তোড়ে ঋণ সরবরাহের বাণিজ্যিক দিকটি উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে। এতে সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘দারিদ্র্য বিমোচনের’ বোঝা চাপিয়ে অদক্ষতার দিকে ঠেলে দেওয়ার পথও তৈরি হচ্ছে।
অদ্ভুতভাবে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ধারায় এই আবেগের প্রকাশ দেখা যায়। দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে লিপ্ততা দেখিয়ে এনজিও/ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো নিজেদের প্রচলিত করজালের আওতার বাইরে রাখতে সচেষ্ট থেকেছে (অর্থাৎ কর না দিয়ে স্বল্পমেয়াদি লাভে আগ্রহী থেকেছে) এবং বিদেশি ঋণদানকারী/সাহায্য সংস্থা এ ব্যাপারে নৈতিক সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে বিশেষ সহায়তা পায় বলে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যপরিধি ও কার্যবিধির ওপর শর্তারোপের দাবি উঠেছে। যেমন—বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা বহু বছর এসব (এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ) প্রতিষ্ঠানের দ্বারা পরিচালিত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে এসেছে। অথচ নীতি পর্যায়ে অনুধাবন প্রয়োজন যে গুণগতভাবে ক্ষুদ্রঋণ একটি পৃথক সেবা, যা সনাতনী বাণিজ্যিক ঋণ থেকে আলাদা; দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা সংস্থাগুলোর স্থায়িত্ব আনার জন্য যোগ্যদের গ্রামীণ/আঞ্চলিক ব্যাংকে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরির প্রয়োজন; কর মওকুফের মাধ্যমে নয়, বরং ভিন্ন প্রণোদন-নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের এদের ভূমিকা অধিক নিশ্চিত সম্ভব এবং সুদ বেঁধে দেওয়ার ঢালাও নীতি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করবে।
নিবন্ধটির বিস্তৃত রূপ পাওয়া যাবে www.ergonline.org সাইটে।
সাজ্জাদ জহির: ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক।
sajjadzohir@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.