ইভ টিজিং : সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক by সি এ খান

আত্মহত্যা কারো কাম্য নয়। তবুও নিজেকে নিজে হত্যার ব্যাপারটি প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ঘটে আসছে। রাজা-বাদশাহ, কবি-সাহিত্যিক, আমলা-কর্মচারী, কৃষক-মুটে-মজুর, ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়।
এ প্রবণতা বা নিজের জীবন নিজেই সংহার করার মতো ঘৃণ্য কাজে নিরুৎসাহী করার লক্ষ্যে আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন থেকে আমরা ঐশী বাণী লাভ করি। মানুষও মানবিক দিক বিবেচনায় সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে আত্মহত্যাবিরোধী আইন-কানুন প্রণয়ন করেছে এবং করছে। স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষার এটি চমৎকার প্রয়াস। কিন্তু বিধি বাম (!) হয়ে যায় কারো কারো জন্যও। সমাজের দুরাচার কিছু খারাপ মানুষ সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুন, নীতিশৃঙ্খলা ভূলুণ্ঠিত করে চলছে। তারা আত্মহত্যাকে উৎসাহী করে চলছে। ইভ টিজিং বা মহিলাদের উত্ত্যক্ত করার মাধ্যমে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিচ্ছে বা যাতে নিজেকে নিজে হত্যা করে তার লক্ষ্যে বিরূপ পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করে, উপাদান জোগাড় করে সহায়তা করছে। এটি একধরনের পরিকল্পিত দুষ্কর্ম। সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে যা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
ইভ টিজিং শব্দের সরাসরি প্রয়োগ না থাকলেও আমাদের দণ্ডবিধি ও মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের মধ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত না হতে হয় বা কেউ মেয়েদের উত্ত্যক্ত না করতে পারে তার জন্য ধারা-বিধি রয়েছে। এসব ধারার সনি্নবেশ নারী ধর্ষণ, বিবাহ, ব্যভিচার, সম্পর্কিত ধারার অতিরিক্ত। দণ্ডবিধি ২৯৪, ৩০৫, ৫০৯, ৩৫৪ ধারা এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা। দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারায় অশ্লীল কার্য ও সংগীত সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে ক. কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে; অথবা খ. কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা তনি্নকটে গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ তিন মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৩৫৪ ধারায় কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে আক্রমণ ও তার প্রতি অপরাধমূলক বল প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে বা সে তদ্দ্বারা তার শালীনতা নষ্ট করতে পারে জেনে তাকে আক্রমণ করে বা তার প্রতি অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে, সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে_যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৫০৯ ধারায় আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোনো মন্তব্য করে, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে যে ওই নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায় কিংবা ওই নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে_যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। পুলিশ অধ্যাদেশেও মহিলাদের উত্ত্যক্ত করার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখানে হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে, যা কোনো গৃহ বা দালানের ভেতর থেকে হোক বা না হোক কোনো মহিলা দেখতে পায়, অথচ স্বেচ্ছায় কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোনো মহিলাকে পীড়া দেওয়া বা তার পথ রোধ করে অথবা কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার স্থানে অশালীন ভাষা ব্যবহার করে অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোনো মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। ইভ টিজিং সভ্যতা ও মানবতার কলঙ্ক।
সময় ও অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনকে যুগোপযোগী করা দরকার হয়। যৌন নিপীড়ন বা হয়রানি সম্পর্কে হাইকোর্টের রায় সে সত্যালোকের দিকে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে। আমরা সভ্য যুগে বাস করে নারীর আত্মহনন-চেষ্টার অন্তত একটি দিক বা উপায় বন্ধ করতে পারি। প্রয়োজনে দণ্ডবিধির ৩০৫ ও ৩০৬ ধারার মতো আইন যৌন নিপীড়ন রোধে করতে পারে। ইভ টিজিং বা ইভ টিজিং হেতু কোনো মৃত্যু সভ্য মানুষের কাম্য নয়। এ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়। আইন-নৈতিকতা ও প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। অহেতুক কারো বিরুদ্ধে ইভ টিজিংয়ের অপবাদ দিলে যাতে মিথ্যা অপবাদকারী বা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তার জন্যও পরিষ্কার আইনি ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবেই কেবল আইন সবার জন্য সমান হবে, আইনের চোখেও সবাই সমান হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মধ্য দিয়েই সবার কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক : আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.