যুক্তি তর্ক গল্প-নাগরিকদের আরও সক্রিয় হতে হবে by আবুল মোমেন

আজকের দিনে আমাদের এবং বেশির ভাগ দেশেই রাজনীতির মূল লক্ষ্য ক্ষমতা। তবে রাজনীতির ক্ষেত্র হওয়ার কথা দেশ ও দশের সেবা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিংকনের ভাষায়, রাজনীতি (অর্থাৎ গণতন্ত্র) হলো জনগণ কর্তৃক (অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার কর্তৃক) জনগণ দ্বারা (কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার মিলিয়ে


জনপ্রতিনিধিত্বের বৃহত্তর পরিসর) জনগণের (অর্থাৎ সাধারণ জনগণ) জন্য পরিচালিত সরকার। তিনি বলেছেন, ডেমোক্রেসি ইজ দ্য গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল। আমরা কি গণতন্ত্রের গাড়ি সঠিক পথে চালাচ্ছি?
সংজ্ঞানুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের ক্ষমতায়ন। তাই গণতন্ত্রে নেতৃত্ব (তথা ক্ষমতা) একক বা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে নিম্ন তথা স্থানীয় পর্যায়ে বিকেন্দ্রিত হওয়ার কথা। এভাবে একজন নাগরিক করদাতা ও ভোটার হিসেবে ক্ষমতার কিছুটা অংশ ভোগ করার সুযোগ ও অধিকার পান।
আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী আমলে যখন গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাতারে থেকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ হিসেবে গণমুখী দর্শন ও বক্তব্য স্থান পেয়েছে, প্রাধান্য পেয়েছে। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে এ দেশে জনপ্রিয় নেতাদের উত্থান হয়েছে। মানুষ এসব নেতাকে সম্মান ও ভালোবাসা দিয়েছে; তাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্যকে আস্থায় নিয়েছে ও পছন্দ করেছে। কিন্তু এই ভক্ত-সমর্থকেরা কখনো তলিয়ে দেখেনি, তাদের পছন্দের দল পরিচালিত হয় কীভাবে? তাতে কি তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে বা সব সিদ্ধান্তে মতামত দেওয়ার কিংবা ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনার সুযোগ কি থাকে? স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বা পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রামের সময় মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার অবকাশই ছিল না; বরং নেতৃত্বের ওপর অন্ধবিশ্বাস করতেই চেয়েছেন দলীয় সদস্য, কর্মী ও বিভিন্ন স্তরের নেতা। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও এ ধরনের ক্যারিশমেটিক নেতাদের উত্থান আমরা দেখেছি। ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হয়ে আসছে। কিন্তু সেই তখন থেকে আমৃত্যু, অর্থাৎ ১৯৬৪ পর্যন্ত জওহরলাল নেহরুই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৬ বছর টানা প্রধানমন্ত্রী থাকার অর্থ হলো, তিন-তিনটি নির্বাচনও প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারেনি। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক নির্মম হত্যাকাণ্ড না ঘটলে তিনিও যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই অনেক দিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন, তা বলা যায়।
নেহরু এবং শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরা সরকার ও দলের মধ্যে পার্থক্য রেখেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে নানা সমস্যা ও বিরোধিতার মুখে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বাড়াতে হয়েছিল। আর তাঁর অবর্তমানে বাংলাদেশ দীর্ঘ সামরিক ও ছদ্মসামরিক স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে যায়। আমরা দেখি, স্বৈরসামরিক শাসকদের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে করতে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলেও ক্রমেই ক্ষমতা একক নেতৃত্বে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ভারতে নেহরুর পরে তাঁর কন্যা ইন্দিরার আমলে, বিশেষ করে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি সরকার ও দলপ্রধান হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পুঞ্জীভবন ঘটান। আমাদের এখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগে এ ঘটনা আরও গভীর ও জোরালোভাবে ঘটেছে। ইন্দিরার পরাজয় কংগ্রেসে আবারও গণতন্ত্রের পক্ষে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে ১৯৯০-পরবর্তী কোনো গণতান্ত্রিক আমলেই প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ও দল পরিচালনার কোনো বিকল্প দেখা যায়নি; বরং দিন দিন যৌথ নেতৃত্বের সামান্য বাস্তবতাও লোপ পাচ্ছে।
এই কর্তৃত্বপ্রবণ নেতৃত্ব ও ক্ষমতার পুঞ্জীভবন রাজনীতিতে গভীর সংকট সৃষ্টি করছে। রাজনীতি সুস্থ-সতেজ চিন্তাচর্চার অবকাশ তৈরি করতে পারছে না। রাজনীতিতে সুস্থ গঠনমূলক বিতর্ক উত্থাপনের সুযোগ থাকছে না। রাজনীতিতে জনপ্রিয় তরুণ ও নতুন নেতৃত্বের বিকাশ সংকুচিত হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি ও দলের শাখার নেতা-কর্মীদের ভূমিকার তুচ্ছতা বা নগণ্যায়ন ঘটছে। রাজনীতিতে কর্মী ও সমর্থকদের ভূমিকা একেবারেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এভাবে গণতান্ত্রিক দলগুলো স্থবিরতায় ভুগছে, ক্রমে তামাদি হয়ে পড়ছে এবং সে সঙ্গে কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এ কথা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—উভয় দল সম্পর্কেই খাটবে।
এই বাস্তবতাকে আমাদের রাজনৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে স্বীকার করতে হবে। জগদ্দলের মতো আমলাতন্ত্র এবং যথেষ্ট দুর্নীতিপ্রবণ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে যা চলছে, তাকে সুস্থ রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলার উপায় নেই; বরং বলতে হবে রাজনৈতিকভাবে আমরা একটি অবক্ষয়ের কালেই আছি। ফলে এ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যাপক দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা, হিংসা ও নাশকতার মতো ভাবনা ও কর্মকাণ্ড চলতে পারে, অনেকাংশে চলছেও।
পাশাপাশি আমাদের স্বীকার করতে হবে, দেশ নানা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি উৎপাদন, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, শিক্ষার হার ইত্যাদি উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকের চেয়েই এগিয়ে আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উদ্বেগজনকও বটে। যেমন: ধনী-দরিদ্রে বৈষম্য বেড়ে চলেছে, শিশু-নারীদের পুষ্টিচিত্র আশাব্যঞ্জক নয়, সর্বপর্যায়ে শিক্ষার মান হতাশাজনক, বিনিয়োগের হার ও কর্মসংস্থান আশানুরূপ না হওয়ায় তার ফল হিসেবে বেকারত্বের হার বেশ উঁচু, সামাজিক অপরাধ ও দুর্নীতি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। ৪০ বছরের অর্জন ও ব্যর্থতাকে যদি সম্ভাবনার সঙ্গে তুলনা করি, তখন অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যায় না; বরং পরিস্থিতি নিয়ে আফসোস হয়। একটি দেশ তার জনগণসহ প্রাকৃতিক সম্পদ মিলিয়ে সম্ভাবনার একটি দিক তুলে ধরে। সম্ভাবনার আরেকটি দিক সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আমাদের জমি কম হলেও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উর্বর এই ভূমি। আবার জনসংখ্যা বেশি হলেও তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়। গ্যাস-কয়লা-কৃষিসম্পদ এবং কৃষিকাজে দক্ষ বিশাল জনশক্তি মিলিয়ে আমাদের প্রাকৃতিক সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর ১৯৭১, ১৯৯১ ও ২০০৮—ইতিহাস ও রাজনীতি জাতির যাত্রাপথে এই তিনবার আমাদের সামনে দেশগড়ার বিশাল সুযোগ হাজির করেছিল। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মতো প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি, তেমনি আবার দেশের অভ্যন্তর থেকেই ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নিতে কসুর করেনি অপশক্তি। ১৯৭১-এর পর জাসদের নামে আর ১৯৭৫-এ বিপথগামী কিছু সামরিক ব্যক্তি দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে একদিকে ইতিহাস বিকৃতিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লক্ষ্যবিরোধী কাজ শুরু করে, অন্যদিকে একক নেতৃত্বের অধীনে দলীয়ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। বিএনপি অবশ্য সামরিক ছদ্মগণতন্ত্রের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে চলছিল।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি দল হওয়া সত্ত্বেও দেখা গেছে, দীর্ঘ দুই দশকের বেশি যে এককেন্দ্রিক কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে এসেছে, নিজেরাও তার সংস্পর্শে এসে একসময় এই প্রবণতার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আজ আওয়ামী লীগ সুপার সভানেত্রীর অধীনে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সুপার প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোনোরকম অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ব্যতীত পরিচালিত হয়ে আসছে। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক অবক্ষয় ও স্থবিরতা এবং পশ্চাৎপদতা কেবলই জোরদার হচ্ছে। দুর্নীতি, অপরাধ, ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়ে চলেছে। আওয়ামী লীগে এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তোষামোদের রাজনীতি চালু হয়েছে, তাতে গণতন্ত্রের বিকাশ অসম্ভব। বলা যায়, জনগণ যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করছে, যেভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে চলেছে, তা রাজনৈতিক অবক্ষয়ের জগদ্দলে এসে মুখ থুবড়ে পড়ছে।
এ ধরনের গণতন্ত্রের সবচেয়ে ভালো যেটুকু হতে পারে তা হলো, কোনো পরোপকারী একনায়কের (অর্থাৎ বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটর) আবির্ভাব। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, অর্থাৎ যেখানে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন এবং সরকার পরিবর্তন ঘটে চলেছে, সেখানে একনায়কের আবির্ভাব হতে পারে কি না, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। হয়তো সামরিক একনায়কের ছদ্মগণতন্ত্রের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছদ্মপরোপকারী একনায়কের জন্ম হতে পারে। কথা হলো, ছদ্মবেশ তো ছদ্মবেশই—দাঁড়কাক তো আর ময়ূর হতে পারে না।
রাজনৈতিক দল এই অবক্ষয় ও স্থবিরতার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে না পারলে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমে নাগরিক সংস্থাগুলোকে সরব ও সক্রিয় হতে হবে। তারপর ছাত্র-তরুণ, নারী, পেশাজীবী এবং জনগণের অন্যান্য ফোরাম থেকে গণতন্ত্রায়ণের দাবি ও চাপ বাড়াতে হবে। এভাবেই গণতন্ত্র ও রাজনীতি অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। আর তখন দেশও ব্যর্থতার বৃত্ত ভেঙে সফল হতে পারবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.