উদ্ধার-তৎপরতা থেমে গেছে-ইলিয়াস আলী নেই?

বনানীর সিলেট হাউসে মূল ফটকের ওপর ঝুলছে চারটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। এগুলো এমনভাবে বসানো যে, এসব ক্যামেরা এড়িয়ে ওই বাড়িতে মাছি গলারও সুযোগ নেই। উপরন্তু সকাল-বিকেল আসছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওচিত্র দেখে যাচ্ছেন তাঁরা।


বাড়িটির মালিক বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলী। চালকসহ তিনি নিখোঁজের পর থেকে নিরাপত্তার নামে এভাবেই বাড়ির বাসিন্দাদের কড়া নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ। তবে দুই মাসেও বাড়ির মালিক ইলিয়াস ও তাঁর গাড়িচালকের খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশ। তাঁদের উদ্ধারে সামান্য যে তৎপরতা ছিল, তা-ও থেমে গেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আগেই প্রথম আলোর কাছে ইলিয়াস আলীর বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেগুলো কখনো কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
‘ইলিয়াসের বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়’ শিরোনামে এর আগে প্রথম আলোতে সংবাদও প্রকাশিত হয়। এখন বিভিন্ন মহল থেকে নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে, ইলিয়াস আলী আর বেঁচে নেই। তাই খোঁজার তৎপরতাও নেই। ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁর নিখোঁজ-সংক্রান্ত বক্তব্যের সেই পুরোনো কথাই শুনিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ব্লগ ও ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এতে বলা হয়, ইলিয়াসকে তুলে নেওয়ার সময় সামনে-পেছনে দুটি দল ছিল। একটি দল পেছন থেকে গাড়িতে ধাক্কা দিলে চালক আনসার গাড়ি থেকে নেমে পেছনের গাড়ির লোকজনের সঙ্গে রাগারাগি করেন। ওই সময় অপর গাড়িটি ইলিয়াস আলীর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। প্রথমে মারধর করে পেছনের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় গাড়িচালক আনসারকে। সামনের গাড়িতে ইলিয়াস আলীকে তোলা হয় দ্রুত। এরপর ঝড়ের বেগে দুটি গাড়ি ছুটে চলে দুই দিকে।
অবশ্য এ ধরনের খবর সম্পর্কে র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা কিছুই বলতে পারেননি। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইলিয়াসকে খোঁজার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ব্লগ ও ফেসবুকের লেখা সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।’ র‌্যাবের কাছেও এ ধরনের কোনো তথ্য নেই বলে জানান র‌্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল।
যে যা-ই বলুক, ইলিয়াস আলীর ফেরার আশায় বুক বেঁধে আছেন তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে, কী অবস্থায় আছে, কিচ্ছু জানি না। যদি নিশ্চিত জানতাম কেউ ওকে মেরে ফেলেছে, তা-ও হতো।’
গত ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার আলী। রাস্তার ওপর পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটি। এরপর একাধিক সূত্র এই সন্দেহই নিশ্চিত করেছে যে, ইলিয়াস আলী সম্ভবত আর জীবিত নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এ ব্যাপারে বলেন, তাঁরাও আশা করেন, ইলিয়াস আলী ফিরে আসবেন। প্রধানমন্ত্রী ইলিয়াসের পরিবারকে এমন আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে বিএনপি আশাবাদী হতে চায়। তিনি বলেন, সরকার কিছু লোক-দেখানো অভিযানের কথা বলেছে। কিন্তু তাঁকে উদ্ধারে তেমন কার্যকর কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। উল্টো একজন প্রতিমন্ত্রী তো ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে বিধবা বলে মন্তব্য করেছেন। ইলিয়াসকে উদ্ধারে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
ইলিয়াসকে সরকারি কোনো বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে বলে ঘটনার পর থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্য নেতারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারা অপহরণকারীদের পরিচয় জানে। কিন্তু অপহরণের পর তাঁদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, কোথায় হত্যা করা হয়েছে, কোথায় লাশ ফেলা হয়েছে—এসব তথ্য তাদের কাছে নেই।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজের চার দিনের মাথায় র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে গাজীপুরের পুবাইল এলাকায় নিষ্ফল অভিযান চালায়। অভিযানে র‌্যাবের সঙ্গে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনাও ছিলেন বলে দাবি র‌্যাবের। অবশ্য এ অভিযান ছাড়া ইলিয়াস আলীর খোঁজে আর কোনো অভিযান দৃশ্যমান হয়নি। তবে পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তাদের দাবি, ইলিয়াসকে উদ্ধারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় অভিযান চালানোর বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোনো ফলাফল নেই।
গত মাসে সিলেটের একজন বিএনপির নেতা দাবি করেন, তাঁর মুঠোফোনে ইলিয়াসের নম্বর থেকে ‘মিসড কল’ এসেছে। তবে বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। তাহলে সিলেটের ওই নেতা কেন এমন একটি দাবি করলেন, সেটিও স্পষ্ট করেনি তদন্ত সংস্থাগুলো।
ইলিয়াসের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বিএনপি হরতাল ডাকলেও একপর্যায়ে হারিয়ে যায় ইলিয়াস প্রসঙ্গটি। হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলে বিরোধী দলও আর বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে কথা বলছে না।
ইলিয়াস ও তাঁর গাড়িচালক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় একটি মামলা পর্যন্ত হয়নি। নিখোঁজ হওয়ার পরদিন ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি জিডি করেন। পুলিশ এখনো সেই জিডির সূত্র ধরেই মামলার তদন্ত করে যাচ্ছে। জানতে চাইলে তাহসিনা বলেন, ‘মামলা করব কার বিরুদ্ধে। মামলা করলে যদি ফেরত পাওয়া যেত, তাহলে করতাম।’
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এম সোহায়েল বলেন, র‌্যাব খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে এখনো তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। সংগৃহীত তথ্যগুলো যাচাই করা হচ্ছে। খোঁজার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
কয়েক দিন আগে সিলেট হাউসে দেখা হয় ওই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী মঈনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই তিনি ইলিয়াসের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে যান। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টা পর পর আদালতকে তদন্তের অগ্রগতি জানাচ্ছে পুলিশ। তদন্ত চলাকালে তিনি কিছু বলবেন না বলে জানান। বাড়িতে ক্যামেরা বসিয়ে কেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছেন? জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল-বিকেল পুলিশ এসে সেই ক্যামেরায় রেকর্ড করা দৃশ্য দেখে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, তদন্ত চলছে। এখন এ নিয়ে কোনো কিছুই বলা যাবে না।
ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি জীবন্ত মানুষকে তুলে নিয়ে চলে গেল। এখনো খোঁজ নেই। তদন্ত কী হচ্ছে, তা-ও বুঝতে পারছি না। দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় (প্রধানমন্ত্রীর কাছে) গিয়ে বলে এসেছি। এখনো আশায় আশায় আছি।’
কথা বলার একপর্যায়ে আশাহত তাহসিনা বলেন, ‘এত দিন কারা ওকে ধরে রাখবে বলেন। সন্ত্রাসী চক্র হলে তো মেরেই ফেলত। আমি এ অবস্থা মানতে পারি না। এ জন্য খালি কান্না আসে। ছেলেমেয়েগুলোও এখন হতাশাগ্রস্ত। ঠিকমতো কথাও বলে না।’

No comments

Powered by Blogger.