বাংলাদেশ সারফেস ওয়াটার ইউটিলাইজেশন প্রজেক্ট by ডা. এম এ হাসান

রাজধানী ঢাকায় পানি সংকট তীব্র। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা আরো প্রকট। এ সংকট গরমের দিনে অসহনীয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে এপ্রিল ও মে মাসে দূষিত পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছে। বৃষ্টিতে সারা দেশ সয়লাব হলে বা বন্যা হলেও পানিদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।


আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাসাবো, খিলগাঁও, গুলশান, শ্যামপুর, ভাসানটেক ও হাজারীবাগ এলাকায় এ দূষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। পানি দূষিত হওয়ার বড় কারণ দূষণযুক্ত উৎসক্ষেত্র। পানির সংযোগে ত্রুটি বা ছিদ্র, পয়োনিষ্কাশনের সঙ্গে পানির লাইনের অনিচ্ছাকৃত সংযোগ এবং ব্যাপক হারে পাম্পের সাহায্যে পানি টেনে নেওয়ার জন্য বাইরের দূষণ পানির পাইপে প্রবেশ করে। এ ছাড়া জরাজীর্ণ পাইপ ও নোংরা জলাধার_এসব তো রয়েছেই। পাইপে পানি প্রবাহে যথাযথ চাপ না থাকায় বা পজিটিভ চাপ না থাকায় বাইরে থেকে দূষণ ভেতরে প্রবেশ করে। এ ছাড়া স্থানে স্থানে পানির গুণাগুণ নির্ণয়, মনিটরিংয়ের অভাব, পাইপে ক্লোরিনেশনের অভাব কিছু ব্যাকটেরিয়া ও প্যারাসাইট তৈরিতে সাহায্য করে। এভাবেই দিলি্লতে ভয়ংকর মেটালোব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যা কি না অনেক অ্যান্টিবায়োটিক, বিশেষ করে বিটা ল্যাকটামেজ চেইন সৃষ্টিকারী অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর করে দেয়। বাংলাদেশের ওয়াসার পানিতে নানা ধরনের প্যারাসাইটসহ প্রচুর প্যাথোজেনিকই ইকোলাই রয়েছে। এতে আমাশয়, জিয়ারডিয়াসহ হেপাটাইটিস রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরপর রয়েছে বিশুদ্ধ পানির উৎসের অভাব। এ সংকট উতরাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। রাজধানীতে কিছু খেলার মাঠসহ উন্মুক্ত স্থানে যেমন পরিষ্কারভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যায়, তেমনি বাড়ির ছাদেও এটা করা সম্ভব। টিনের চালায় এটা করা তো খুবই সহজ। তেমনি নতুন জলাশয় নির্মাণ করা যায়। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুরনো পুকুরগুলো খননসহ নতুন পুকুর ও শহরাঞ্চলে দিঘি খনন করা যেতে পারে।
এরই সঙ্গে নগরীতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে একটি ভিন্ন ধরনের প্রকল্পের কথা বলছি আমরা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে একদিকে যেমন সিলেটের হাওর ও ময়মনসিংহে বিল অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদিকে ঢাকায় পানীয় জলের চাহিদাও মেটানো যাবে। এতে সিলেটের হাওরাঞ্চলে পর্যটন শিল্প নির্মাণের পরিবেশ তৈরি হবে। বিশেষ এ প্রকল্পে পাহাড়ি নদী ও বৃষ্টির পানি সিলেট অঞ্চলের হাওর, ময়মনসিংহের বিলসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাধারে সংরক্ষণ করা হবে। বিশেষ নালার মাধ্যমে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মরা নদীতে এ পানি নেওয়া হবে এবং তা ভৈরব ও নরসিংদী পর্যন্ত আনা হবে। এরপর বিশেষ পাইপলাইনের মাধ্যমে (স্টর্ম ওয়াটার পাইপ) এ পানি ঢাকায় আনা হবে। সবশেষে ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জে সহজ পদ্ধতিতে পানি শোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করা হবে। রাজধানীর পানি সরবরাহে উঁধষ ষরহব বাধ্যতামূলক হতে হবে। এর একটি লাইনে সুপেয় জল, অন্যটিতে গোসল ও ধৌত কাজে ব্যবহারের জল সরবরাহ করা হবে। প্রতিটি মহল্লায় ঙাবৎযবধফ ট্যাংক এবং রাজশাহী অঞ্চলের ঢপকলের মতো জলাধার নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন করা গেলে একদিকে রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা মেটানো যাবে, সেই সঙ্গে সিলেটের হাওরাঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে; সিলেট, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় চাষাবাদের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এ থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এ ছাড়া চাহিদার অতিরিক্ত পানি ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগসহ বিভিন্ন নদীতে প্রবাহিত করা যাবে। তাঁরা জানান, 'বাংলাদেশ সারফেস ওয়াটার ইউটিলাইজেশন' নামক এ প্রকল্পটির জন্য সম্ভাব্য ব্যয় হবে এক হাজার কোটি টাকা। কাজ শুরুর দুই বছরের মধ্যেই প্রকল্পের ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যমুনা নদীর পানি বুড়িগঙ্গায় আনার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। কিন্তু যমুনার পানি অনেক বেশি দূষিত এবং প্রকল্পটি ব্যয়বহুল। এ পানিতে যেমন মেটালোব্যাকটেরিয়াসহ ভয়ংকর সব জীবাণু ও পরজীবী রয়েছে, তেমনি রয়েছে আর্সেনিক, পারদ ও ক্যাডমিয়াম। কিন্তু এর চেয়ে নতুন ধরনের এ প্রকল্পটি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব, কার্যকরী, সাশ্রয়ী ও বহুমুখী। এতে সরকারকে কোনো জমি অধিগ্রহণও করতে হবে না।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৩ ডিভিশন, ১৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডসহ বিদেশি দাতাদের এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত করা গেলে ফল আশানুরূপ হবে এমনটি প্রত্যাশা করা যায়। সার্বিক দিক বিবেচনা করে এ ধরনের একটি প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কার্যকর, ফলপ্রসূ ও যুগোপযোগী বলে ধারণা করা যায়।
লেখক : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্টস কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.