কণ্ঠস্বর-হত্যা-গুম ও হরতালের রাজনীতি by রাহাত খান

২০১৪ সালের নির্বাচনে যে দল-গোষ্ঠী ক্ষমতায় যেতে পারে যাক, কিন্তু হরতাল নয়, কিছুতেই হরতাল নয়; রাজনীতিতে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে হরতালের বিকল্প একটা কিছু উদ্ভাবন করা হোক। উদ্ভাবন করতেই হবে। এটা দেশের গরিষ্ঠ অংশের দাবি।


এই দাবি উপেক্ষা করে লাগাতার হরতাল দিতে থাকলে শিগগির এটা জনগণের বিমুখতা ও বিরূপতার মুখে ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হবে_ কোনো সন্দেহ নেই তাতে



দেশের দু'জন সাধারণ নাগরিক। দু'জনই শহরে থাকেন। দু'জনের কেউই সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতিতে জড়িত নন। তবে রাজনীতি-সচেতন বটে। দেশের হালফিল রাজনীতির খবর রাখেন। আগেও রাখতেন। আজ নিবন্ধের শুরুতে এই দু'জনের কথোপকথন, রাজনীতি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব তুলে ধরতে চাই। হরতাল এবং হরতালের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরতে চাই নিবন্ধের শুরুতেই।
তবে বলে রাখা ভালো, যে কোনো লেখায় লেখক কোনো না কোনোভাবে ঢুকে পড়েন। কখনও কখনও জেনেশুনে, কখনও নিজের অজান্তে। না ঢুকেও তো উপায় নেই। এই যেমন দুই নাগরিক বাংলায়ই, তবে দুই মিশেল ডায়লেক্টে কথা বলছিলেন। পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে তাদের কথোপকথনটি মূল স্রোতের বাংলায় বিন্যস্ত করে দিতে হয়েছে। তারা কথার মধ্যে এখন-তখন দু'চারটে স্ল্যাং বা অশ্লীল গালিগালাজ উচ্চারণ করছিলেন। মানুষ তাদের প্রতিদিনকার কথাবার্তায় কিছু না কিছু আপত্তিকর শব্দ উচ্চারণ করেই থাকে। গালিগালাজ হচ্ছে দুনিয়ার যে কোনো ভাষায় খুব শক্তিশালী উচ্চারণ। ভাষার অ্যাসেট বা সম্পদ। তবে পত্রিকার কোনো সম্পাদক তো আইনগত এবং রুচিগত কারণে লেখায় কোনো গালিগালাজ বরদাশ্ত করবেন না। যেটা আমি জানি, পাঠক-সাধারণও জানেন। কাজেই হরতাল এবং হরতালের রাজনীতি সম্পর্কে কথোপকথনে উচ্চারিত গালিগালাজ লেখক হিসেবে নিজেই ছেঁটে দিয়েছি। কথোপকথন উপস্থাপনায় লেখকের আরও কিছু অনিবার্য সম্পৃক্ততা আছে এবং সেটি থাকাটাই স্বাভাবিক। যা-ই হোক, গৌরচন্দ্রিকার ইতি টেনে হালফিল হরতাল ও হরতালের রাজনীতি নিয়ে দু'ব্যক্তির কথোপকথনটি নিচে বর্ণনা করা হলো।
প্রথম জন : কী ভাই, ভালো আছেন তো?
দ্বিতীয় জন : মোটামুটি ভালোই আছি আল্লাহর রহমতে। তো বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে কতদিন ভালো থাকতে পারব, কে জানে! দেশে যা শুরু হয়েছে...
: কেন ভাই, দেশে কী শুরু হলো?
: দেশে কী শুরু হয়েছে, জানেন না! আপনি কি কানে তুলা দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকেন নাকি! দুধের বাচ্চাটাও তো জানে দেশের এখন মহাবিপদ। জাতি এখন মহাসংকটে! গুম আর হত্যার রাজনীতি যেভাবে শুরু হয়েছে তা কোথায়, কীভাবে শেষ হয়, কে জানে...
: হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই বলেছেন। মানুষের মধ্যে এখন একটা ভয় আর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি আর অর্থনীতিকে যে রকম ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে, সেটিও দেশের জন্য, জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়!
: কেন ভাই, হরতাল তো রাজনীতির বহুচর্চিত প্রতিবাদের ভাষা। রাজনীতিতে মানুষের একটা মৌলিক অধিকার! হরতাল করায় কী এমন অন্যায়টা দেখলেন...
: না, না হরতাল তো রাজনীতিতে মানুষের একটা মৌলিক অধিকারই বটে। হরতাল করায় তো কোনো অন্যায় দেখি না...
: তাহলে?
: না, মানে বলছিলাম হরতাল করাটা যেমন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, হরতাল সমর্থন না করাটাও তো মানুষের মৌলিক অধিকার!
: আপনার কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না সায়েব। আরেকটু ঝেড়ে কাশুন না,... কী বলতে চান, পরিষ্কার করে বলেন...
: বলার তো কিছু নেই। হরতাল দিলেন সেটা ঠিক আছে। তবে হরতাল সফল করার জন্য আগের দিন সন্ধ্যা এবং রাতে গাড়ি ভাংচুর করা, বোমা ফাটানো, হরতালের দিন একই কায়দায় গাড়ি ও রাস্তার পাশে খোলা দোকানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, পেট্রল ঢেলে মানুষ পুড়িয়ে মারা_ এগুলোও কি গণতান্ত্রিক অধিকার? হরতালের নামে তো এসবই হচ্ছে...
: অস্বীকার করি না যে হচ্ছে না। কিন্তু শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করতে দেবেন না, পুলিশ আর র‌্যাব বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে, লাঠিচার্জ করে মিছিল ভেঙে দেবে, এটাও তো ঠিক কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণের মধ্যে পড়ে না। আজকাল হচ্ছে তো সে রকমটাই!
: পুলিশের ওপর, র‌্যাবের ওপর অর্পিত দায়িত্বই হলো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকারীদের দমন করা, সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা করা, বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হতে না দেওয়া! র‌্যাব-পুলিশের দোষটা কোথায় বলেন...
: র‌্যাব বা পুলিশ বাহিনীর ওপর দোষ দিই না। টেলিভিশনের নিউজে তো হরহামেশাই দেখছি, কোত্থেকে একদল লোক বেরিয়ে এসে র‌্যাব-পুলিশের ওপর ইটপাটকেল মায় হাতবোমা ছুড়ে মারছে! বেশিরভাগ সময়ই বিনা উস্কানিতে। থানা পর্যন্ত আক্রমণ করা হচ্ছে, পুলিশের হাতের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হচ্ছে! আবার টেলিভিশনের ফুটেজে এও দেখি, সরকারি দলের ছাত্র নামধারী গুণ্ডা বাহিনী হরতালের সমর্থকদের ওপর লাঠি, ছুরি, পিস্তল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে! কোনোটিই তো সমর্থনযোগ্য নয়। তবে কথায় বলে না, কেউ যদি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে, করারও তো কিছু নেই...
: ভাই সায়েব, কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না...
:সহজ কথাটা না বোঝার কী আছে ভাই! গুম আর হত্যার রাজনীতি শুরু হলে এর একটা ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া তো হবেই। গণআন্দোলন আর গণঅভ্যুত্থানের সময় এসব ঘটেই থাকে এবং গণতন্ত্র ও জনগণের স্বার্থে মানুষও সেগুলো মেনে নেয়...
: গণঅভ্যুত্থান! গণআন্দোলন! সেটা কিসের জন্য ভাই? আমরা তো জানি, জনগণের নির্বাচিত একটা মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে। জনগণ যদি মনে করে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ, তাহলে ২০১৪ সালেই তো সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। তেমন হলে জনগণ নিজেরাই ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার বদলে দিতে পারে। বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে পারে। গণতন্ত্রের সেটাই দস্তুর। তা না করে লাগাতার হরতালের ডাক দিয়ে হরতালের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সাংঘর্ষিক করে তোলা কেন? কেন লাগাতার হরতাল ও সন্ত্রাস চালিয়ে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো...
: হাসালেন সায়েব। নির্বাচিত সরকার হয়েও স্বৈরাচারী সরকারের আচরণ করবেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর জুলুম করবেন, হামলা-মামলা করবেন, শান্তিপূর্ণ মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ-র‌্যাব বাহিনী লেলিয়ে দেবেন, গুম আর হত্যার রাজনীতি শুরু করবেন আর দেশের মানুষ বুঝি ওসব ছেঁদো বুলি শুনে চুপ করে থাকবে!
:তা থাকবে কেন। মানুষ তো যন্ত্র নয়, রক্ত-মাংসে গড়া_ নির্যাতন, হত্যা-গুম আর হামলা-মামলার প্রতিবাদ করবেই। সেটা একেবারে অনিবার্য। কিন্তু ভাই, আমার প্রশ্ন, দেশে তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে কি! আমার তো মনে হয় বর্তমান সরকারের কিছু ব্যর্থতা যেমন আছে, পাশাপাশি সাফল্যও রয়েছে অনেক। কিছু সাফল্য তো রীতিমতো যুগান্তকারী।
: আপনি আবার এই সরকারের সাফল্য দেখলেন কোথায়?
: রাজনীতির অমন সরলীকরণ করবেন না স্যার! তাতে আপনার, আমার দু'জনেরই বিভ্রান্তি শুধু বাড়বে।
: বহুত কঠিন বাক্য আওড়াচ্ছেন ভাই। সরল বাংলায় বলেন।
:দেশে প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দেশে বোমাবাজি আর সন্ত্রাস বন্ধ করা, জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ দমন করা_ এসব কিছু সাফল্যই তো, নাকি? ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটানো, ঠিক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের বই তুলে দিতে পারা, বিশ্বমন্দা বিরাজ করা সত্ত্বেও দেশের রফতানি ভলিউম ৩৭ ভাগ বাড়াতে পারা, ২৮ লাখ লোককে বিদেশে পাঠিয়ে এবং দেশে সুযোগ সৃষ্টি করে গত তিন বছরে আরও সাড়ে ৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা_ এগুলোও বর্তমান সরকারেরই অর্জন। তা ছাড়া মন্দার মধ্যেও বার্ষিক উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারা নিশ্চয়ই একটা সরকারের সাফল্যেরই গল্প। আর ধরুন, গত তিন বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বাড়াতে পারা, আন্তর্জাতিক আইনের শান্তিপূর্ণ ধারায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমান আরেকটা সমুদ্রসীমা নিজেদের অধিকারের মধ্যে আনতে পারা_ এগুলো তো ভাই যে কোনো বিচারেই যুগান্তকারী সাফল্য। বাংলাদেশকে এখন একটা উদ্যমী, উৎপাদনশীল এবং খুব সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে সারাবিশ্ব।
: থামেন, থামেন সায়েব। আপনি তো দেখছি সরকারের চামচাগিরি শুরু করে দিয়েছেন।
: সত্যি কথা আওড়ালে এর নাম যদি চামচাগিরি বলা হয়, তাহলে বলার কিছুই নেই।
: সত্যি কোনটা সেটা দেশের মানুষও জানে। তারাও বুঝতে পারে। তবে আশা করি হত্যা ও গুমের রাজনীতি, হামলা-মামলা জায়েজ করার চেষ্টা করবেন না। ইলিয়াস আলী একজন জাতীয় নেতা। তাকে যে সরকারের এজেন্সির লোকজন জোর করে ধরে নিয়ে গেল, গুম করে ফেলল, এটা তো জাতির জন্য এক মহা অশনিসংকেত। গণতন্ত্র যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুই-ই হারিয়ে একটা স্বৈরতান্ত্রিক ধারার দিকে দ্রুত ধাবমান হচ্ছে_ এসব তো অস্বীকার করা যায় না।
: না, যায় না! গণতন্ত্র যদি স্বৈরতন্ত্রের পথে হাঁটে, তবে সেটা জাতির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই একটা অশনিসংকেত। ইলিয়াস আলীর এতদিন পর্যন্ত নিখোঁজ হয়ে থাকাটা অবশ্যই খুব দুর্ভাগ্যজনক। ইলিয়াস আলীকে এখনও উদ্ধার করতে না পারাটা সরকারের জন্য একটা ব্যর্থতা বৈ কিছু নয়। তাকে অবিলম্বে খুঁজে বের করার যে ইদানীংকার রাজনীতির প্রতিবাদ_ ভাই, সেই প্রতিবাদের মধ্যে আমিও আছি। তবে জনাব, সত্যের খাতিরে বলি, ইলিয়াস আলী একজন রাজনীতিক বটে, তবে জাতীয় স্তরের কোনো নেতা নন। তিনি সিলেটের একজন স্থানীয় নেতা_ এইমাত্র বলা যায়...
: অর্থাৎ আপনার মতে ইলিয়াস আলী গুম হওয়ায় এই জাতির কিছু যায় আসে না। হত্যা আর গুমের রাজনীতি চলতেই থাকবে! বিরোধী দলকে হামলা-মামলা আর হেয়-হেনস্থা করে আমাদের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মহান কার্যকলাপ চলতেই থাকবে এবং এর পরও পাখি পড়ার মতো বলতেই হবে সরকার পতনের ডাক দেওয়া চলবে না, সেটা গণতন্ত্রের খেলাপ?
: না, না ভাই, আমি তেমনটা কেন বলব! হত্যা ও গুমের রাজনীতি অবশ্যই গর্হিত, ঘৃণিত এবং ধিক্কারের রাজনীতি। কোনো সন্দেহ নেই তাতে। তবে সরকারই ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে অথবা বিরোধী দলই তাকে একটা ইস্যু সৃষ্টির জন্য গায়েব করে দিয়েছে_ এই দুইয়ের কোনটা যে সত্য, তা বলা কিন্তু সহজ নয়। এই অবস্থায় ...
: থামলেন কেন, ... এই অবস্থায় কী?
: না মানে, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ইস্যুতে বিরোধী দল দেশে সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, আন্দোলন ইত্যাদি তো করতেই পারে। তবে এ জন্য সরকার পতনের ডাক দেওয়া, লাগাতার হরতাল দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা, অর্থনীতি ধ্বংস করা, আমার মতে সমর্থনযোগ্য নয়...
: কেন ভাই সায়েব, বর্তমান সরকার বিরোধী দলে থাকতেও তো হরতাল দিয়েছে। দেয়নি?
: দিয়েছে। হরতাল সাকসেসফুল করার জন্য ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও চালিয়েছে। এসবও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। হরতাল দেওয়া ঠিক আছে, তবে হরতাল সফল করার জন্য গাড়ি ভাংচুর, বোমাবাজি, দোকানপাটে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, এগুলো অবশ্যই কোনো দলের বা গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। কোনো অন্যায়ের বিপক্ষে প্রতিবাদ হিসেবে রাজনীতিতে হরতাল দেওয়া কিংবা হরতাল সমর্থন করা যেমন একটা গণতান্ত্রিক অধিকার, হরতালে সমর্থন না দেওয়াটাও তেমনি গণমানুষের এটা গণতান্ত্রিক অধিকার।
: সবই তো স্বীকার করলেন। তাহলে দেশের এই যে সংকট, রাজনীতির এই যে দুর্দিন, এসবের জন্য কাদের দায়ী করব আমরা?
: আমার সাফ জবাব, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতপ্রাপ্তির পর বাংলাদেশে যে দূষিত রাজনীতির সূচনা ঘটেছিল এক সমরনায়কের হাত ধরে, সেই হত্যা-গুম, স্বাধীনতাবিরোধীদের সমাজে পুনর্বাসন, ইতিহাস বিকৃতি এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিই এ জন্য মূলত দায়ী। বিশেষত দেশের প্রধান একটি দল যে মুহূর্তে স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, ইসলামবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে নিজেদের পরিবারভুক্ত দল হিসেবে একেবারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিল, সেদিন থেকেই বোধকরি দূষিত রাজনীতির ধারাটি পূর্ণতা পেয়েছিল। ২০০১-০৬ সময়-পর্বে দূষিত রাজনীতি, হত্যা ও গুমের রাজনীতি, লুটপাট ও দুর্নীতির রাজনীতি চরমে পেঁৗছে যায়। ওই পর্বে বাংলাভাইদের উত্থানের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশ, পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক আয়োজন, ২১ আগস্টে বোমা ও গ্রেনেড চার্জের কথা? বোমা আর গ্রেনেডবাজি সংস্কৃতির জনক কারা ছিল? কারা পৃষ্ঠপোষকতা দিত? আর হাওয়া ভবন? ভুলে গেছেন দুর্নীতি, হত্যা, গুম আর বিষাক্ত রাজনীতির সেই স্বর্ণযুগের কথা? সে সময় সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে; কিন্তু এতসব অনাচারের পরও সরকার পতনের ডাক দেওয়া হয়নি তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। অথচ এখন বিরোধী দল সত্যিকারের কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইস্যু না থাকা সত্ত্বেও, নিজেদের দলেই বেয়াদব এবং সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ইলিয়াস আলীর হঠাৎ অন্তর্ধানের ঠুনকো ও হাস্যকর ছুতো ধরে সরকার পতনের নামে লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এটা বিষাক্ত রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা। জামায়াত ও তার পরিবারভুক্ত প্রধান দলটি বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে। হয়তো তারা বুঝে গেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার দেশ-উন্নয়নের যে ধারায় এগিয়ে চলেছে তাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদ পাওয়ার বেশি সম্ভাবনা তাদেরই।
কথোপকথন আরও দীর্ঘ ছিল। তবে সেই সংলাপ-প্রতি সংলাপের ইতি টেনে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের উপস্থাপনকারী হিসেবে আমারও দাবি, ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে দল-গোষ্ঠী ক্ষমতায় যেতে পারে যাক, কিন্তু হরতাল নয়, কিছুতেই হরতাল নয়; রাজনীতিতে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে হরতালের বিকল্প একটা কিছু উদ্ভাবন করা হোক। উদ্ভাবন করতেই হবে। এটা দেশের গরিষ্ঠ অংশের দাবি। এই দাবি উপেক্ষা করে লাগাতার হরতাল দিতে থাকলে শিগগির এটা জনগণের বিমুখতা ও বিরূপতার মুখে ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হবে_ কোনো সন্দেহ নেই তাতে।

রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.