আন্ডারগ্রাউন্ড! by আসিফ আহমেদ

পাকিস্তান আমলে বামপন্থি নেতারা 'আন্ডারগ্রাউন্ডে' যেতেন। প্রকৃতপক্ষে পুলিশই তাদের এ জীবনে পাঠাত। তারা কি মাটির নিচে বসবাস করতেন? এ প্রশ্ন অনেককে আলোড়িত করত। তাদের জীবন কেমন কাটত, তা নিয়ে ছিল কৌতূহল।


আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতারা অনেকের কাছে ছিলেন রহস্যময় পুরুষ (নারীদেরও কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন, তবে সংখ্যায় একেবারেই কম)। কেউ কেউ নিজের এমন ভাবমূর্তি তুলে ধরতেও যত্নবান ছিলেন। কারও কারও সম্পর্কে বলা হতো_ পুলিশ তাদের ধরার জন্য খুঁজছে না; কিন্তু 'গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা' হিসেবে নিজেকে জাহির করার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতেন।
কীভাবে চলাফেরা করতেন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতারা, সেটা নিয়েও প্রচুর কৌতূহল ছিল। গোয়েন্দারা তাদের হদিস পেতে চাইতেন হন্যে হয়ে। এ জন্য চর লাগিয়ে রাখতেন। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ ১৯৬৭ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন একটানা ১৯ বছর পালিয়ে থাকার পর। তাকে নাকি দলের এক কর্মীই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার সময়ও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। এ সময়ে (ষাটের দশকের প্রথম দিকে) তিনি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন, যেখানে সিদ্ধান্ত হয়_ আইয়ুব খানের মার্শাল ল' অবসানের জন্য দুটি দলের অনুগত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একযোগে আন্দোলন করবে।
কমিউনিস্টরা আন্ডারগ্রাউন্ডে যায়, কিন্তু বুর্জোয়া দলের নেতারা এ কাজে পারদর্শী নন, এমন কথা বলা হতো সে সময়। এ জীবনে কষ্ট বেশি_ সেটা একটি কারণ। আরেকটি কারণ_ বুর্জোয়া নেতারা নিজেদের জাহির করতে ভালোবাসেন।
এসব ইস্যু থাক। হাল আমলের কথায় আসি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নিতে না নিতেই তিনি 'হাওয়া' হয়ে গেলেন। দলের কর্মীরা বিষয়টি তেমন পছন্দ করেনি, এমন খবর এসেছে সংবাদপত্রে। তাদের বিবেচনায়, নেতা জেলে গেলে অনেক বেশি রাজনৈতিক ফায়দা মিলত। কিন্তু বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশেই মহাসচিব আন্ডারগ্রাউন্ডে। তিনি যে এ কাজে পারদর্শী, সেটার প্রমাণ মিলেছে। অন্তত প্রথম সপ্তাহে পুলিশ তার হদিস করতে পারেনি। বিএনপি বলেছে, তিনি আন্দোলন পরিচালনা করছেন। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজে নির্দেশনা দিচ্ছেন। রাজনৈতিক শব্দভাণ্ডারে বিএনপির মতো দলকে বুর্জোয়া দল হিসেবে অভিহিত করা চলে। তিনি পালিয়ে থাকার কৌশল রপ্ত করায় বামপন্থিরা এ বিষয়ে নিজেদের আধিপত্য খানিকটা হারালেন বৈকি।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে এবং যাদের নামে এ পরোয়ানা তারা পালিয়ে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলে বলা হতো হুলিয়া জারি। এ অবস্থায় স্লোগান উঠত_ '... নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া, নিতে হবে তুলিয়া'। নির্মলেন্দু গুণের 'হুলিয়া' নামে একটি বিখ্যাত কবিতা রয়েছে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক কর্মী কীভাবে কাজ করছেন, সে বিষয়ে ধারণা মেলে এ কবিতায়। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতারা রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য চিরকুট ব্যবহার করতেন। অল্প কথায় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের পুরিয়ার মতো করে তারা বার্তা পাঠাতেন। যাদের কাছে পাঠাতেন, তারা এটা পেয়ে উল্লসিত হতেন। ইতি-কর্তব্য জানতে পারতেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম কি এমন চিরকুট পাঠাচ্ছেন? নাকি আশ্রয় নিচ্ছেন টেলিফোনের?
গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র কখনও কখনও বলে, ওয়ারেন্ট হলেই কাউকে গ্রেফতার করতে হবে_ এমন কথা নেই। কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলে অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। ধরা পড়ার ভয়ে সর্বদা শঙ্কিত থাকে। গ্রেফতার করলে মামলা সাজাতে হয়। কাগজপত্র তৈরি করতে হয়। জামিন চাওয়ার সুযোগ থাকে। মুক্তির দাবি ওঠে সংবাদপত্র-টেলিভিশনে। তার চেয়ে 'মাটির নিচে' থাকুক না যতদিন খুশি। এ সময়ে বিশ্রামেরও অবকাশ মিলবে এবং তাতে শরীর ভালো থাকবে।
মির্জা ফখরুল ইসলামের আলমগীরের দিন কেমন কাটছে এখন?
 

No comments

Powered by Blogger.