শ্রদ্ধাঞ্জলি-পরিশীলিত আড্ডার এক প্রাণপুরুষ সাঈদ আহ্মদ by সৈয়দ জিয়াউর রহমান

অনন্য প্রতিভাধর নাট্যকার, শিল্প-রসিক, সমালোচক ও সংগীতজ্ঞ সাঈদ আহ্মদের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৬ সালে ওয়াশিংটনে—ভয়েস অব আমেরিকায় আমার সহকর্মী ও পরে এই সংস্থায় বাংলা বিভাগের প্রধান ইকবাল আহেমদের বাড়িতে। ইকবাল আহেমদের মামা সাঈদ আহ্মদ। অবশ্যি তার আগে সাঈদ আহ্মদের বড় দুই ভাইকে জানতাম।
এক ভাই নাজির আহ্মদ অল ইন্ডিয়া রেডিও, রেডিও পাকিস্তান ও বিবিসির জনপ্রিয় বেতার ভাষ্যকার এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষক এফডিসির প্রতিষ্ঠাতা। একসময় ঢাকার পুরোনো শহর এলাকার ইসলামপুরে আশেক লেনের বাড়িতে নাজির আহ্মদের সঙ্গে ফতেহ্ লোহানী, নুরুল ইসলাম, দাউদ খান মজলিশের আড্ডার ছিটেফোঁটা নেওয়ার লোভ সামলাতে পারত না বুদ্ধিজীবী মহলের তরুণদের অনেকেই।
আরেক ভাই বিশিষ্ট শিল্পী—ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রাহমানের খ্যাতি ছিল বন্ধুবত্সল হিসেবে। তিনি থাকতেন কানাডার টরন্টোতে। মাঝেমধ্যেই আসতেন ওয়াশিংটনে এবং খোঁজখবর করে মেলামেশা করতেন পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে।
খ্যাতিমান এই দুই ভাইয়ের কনিষ্ঠ সাঈদ আহ্মদের নাট্য প্রতিভার কথা শুনেছিলাম আমার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ঢাকার থিয়েটার গ্রুপ ড্রামা সার্কেলের একনিষ্ঠ পরিচালক, মঞ্চাভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব বজলুল করিমের কাছে। সাঈদ আহ্মদের সঙ্গে এর আগ পর্যন্ত আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। পরিচয়ের পরেই সখ্য—এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগেনি বড় একটা।
গল্প বলার আসর জমানোর আশ্চর্য দক্ষতা ছিল তাঁর। এক রাতে ওয়াশিংটনে আমাদের বাড়িতে এমনই এক আড্ডায় গল্প শুরু করেন সাঈদ আহ্মদ তাঁর লন্ডনের প্রবাস-জীবন নিয়ে। সেখান থেকে প্যারিস, আমস্টারডাম, রোম—গল্পের ঘোড়া চলে এক শহর থেকে আরেক শহরে লাফিয়ে লাফিয়ে, এক ঘটনার সূত্র ধরে আরেক ঘটনার মুখে! আমরা শ্রোতারা শুনছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে, শুনছি বললে ভুল হবে, গিলে যাচ্ছি রীতিমতো। হঠাত্ বক্তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় তাঁর হাতঘড়ির ওপর। ততক্ষণে গল্পের ঘোড়া মিসরের কায়রো পর্যন্ত পৌঁছেছে। সাঈদ আহ্মদ আসরের বিরতি ঘোষণা করলেন। বললেন ‘এখন রাত তিনটা, আজ কায়রো পর্যন্তই থাক। আরেক দিন বাকিটা।’ আমরা শ্রোতারা বুঝতে পারিনি, রাত তিনটা কী করে বাজল। শ্রোতা ধরে রাখার এমনই আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল সাঈদ আহ্মদের।
সাঈদ আহ্মদ বয়সে আমার এক-দেড় বছরের বড়। আমার বন্ধু বজলুল করিমেরও ছিল তাই। কিন্তু বয়স কোনো মাপকাঠি ছিল না সাঈদ আহ্মদের সঙ্গে কারও কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনে। যে কারণে রোমানিয়ায় জন্মলাভকারী পাশ্চাত্যের অ্যাবসার্ড নাটক-এর স্রষ্টা প্রখ্যাত ফরাসি নাট্যকার ইউজিন ইউনেস্কো তাঁর চেয়ে বয়সে প্রায় ২০ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও এবং ওয়াশিংটনে মঞ্চনাট্য পরিচালক গেই অ্যালিসন বয়সে অন্তত ১৫ বছরের ছোট হলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে অসুবিধা হয়নি কোনো।
সুদূর মহাসিন্ধুর এপারে আমেরিকার রাজধানী শহর ওয়াশিংটনের নাট্যজগতে সাঈদ আহ্মদের জনপ্রিয়তা ছিল বিস্ময়কর। ওয়াশিংটনে তাঁর সম্মানিত হওয়ার দুটি স্মরণীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। একটি ওয়াশিংটন শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পটোম্যাক নদীর তীরে এক প্রখ্যাত নাট্যশালা অ্যারেনা মঞ্চে। সেখানে গুণীজন সমাবেশে আয়োজিত এক সংবর্ধনায় নাট্যশালার সবচেয়ে সম্মানিত এক সারি আসনের নামকরণ করা হয় ‘সাঈদ আহমেদ ক্লাসির’। এটি ছিল ১৯৭৬ সালে। ভয়েস অব আমেরিকা থেকে সাঈদ আহ্মদের ওই সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছিলাম তাঁর ওপর একটি বিশেষ বেতার অনুষ্ঠান তৈরির জন্য। অ্যারেনা মঞ্চের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে সাঈদ আহ্মদকে যে সংবর্ধনা জানান, তা ছিল যেকোনো ভিআইপি অতিথির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের পক্ষে ঈর্ষণীয়। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর এখনো নাট্যশালা অ্যারেনা মঞ্চে এক সার আসনের পেছনে চকচকে ধাতব প্লেটে লেখা সাঈদ আহ্মদের নাম উজ্জ্বল।
ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় আরেকটি সংবর্ধনা ছিল সাঈদ আহ্মদের জন্য, ফোর্ড থিয়েটারে আশির দশকের শেষ দিকে। সাঈদ আহ্মদ ও তাঁর সহধর্মিণী পারভীন আহ্মদ আমাকে সস্ত্রীক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে ফোর্ড থিয়েটারে নাটক দেখার। বলেননি সংবর্ধনার কথা। সাঈদ আহ্মদ নিজেও সম্ভবত জানতেন না, তাঁকে ফোর্ড থিয়েটার কর্তৃপক্ষ সম্মানিত করবে। কারণ, তারাও তাঁকে চিঠি দিয়েছিলেন নাটক দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে। রাজধানী শহরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নাইনয় স্ট্রিটে এই ফোর্ড থিয়েটারেই আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দেড় শ বছরেরও আগে, ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল একটি নাটক দেখার সময় আততায়ী অভিনেতা ইউলকিস বোথের হাতে গুলিবিদ্ধ হন এবং সে সময় তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় থিয়েটার ভবনের উল্টো দিকের একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন সেখানেই তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফোর্ড থিয়েটারের কাছাকাছি এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমরা থিয়েটার ভবনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই থিয়েটার কর্তৃপক্ষ ছুটে আসে সাঈদ আহ্মদকে অভ্যর্থনা জানাতে। তারপর আমাদের চারজনকে নিয়ে যাওয়া হয় ওপরের তলায় ব্যালকনিতে, যেখানটায় প্রেসিডেন্ট লিংকন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন, তাঁর পাশে দেশের প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ গণ্যমান্য অতিথির জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় পেতে রাখা আসনে। প্রেসিডেন্ট লিংকনের রক্তাক্ত আসনটি আমেরিকার জাতীয় পতাকায় আবৃত এবং সেটি চারদিকে কাচের দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করে রাখা। আমরা সাঈদ আহ্মদ দম্পতির সঙ্গে ভিআইপি আসনে বসে গ্রান্ডমা মোসেস নামের এক চরিত্রের একটি অসাধারণ নাটকের অভিনয় দেখলাম।
শুধু আসর জাঁকানোর, আড্ডা জমানোর দক্ষতাই নয়, সাঈদ আহ্মদের ছিল অসাধারণ রসবোধ। একবার ওয়াশিংটনে গরমের সময় এক পার্কে বসে আমরা পিকনিক করছিলাম সাঈদ আহ্মদকে নিয়ে। সেখানে আমাদের অজান্তেই কাছাকাছি কোথাও ছেলেমেয়েরা খেলতে খেলতে খোঁচা দিয়েছিল সম্ভবত কোনো ভীমরুলের চাকে এবং হঠাত্ একটি ভীমরুল ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে এসে হুল বসাল একেবারে সাঈদ আহ্মদের ঠোঁটে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রী রকমভাবে ফুলে গেল তাঁর ঠোঁট। আমরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। সাঈদ আহ্মদ নির্বিকার, ভীমরুলের হুলের ব্যথা যথাসাধ্য গোপন করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনাদের কারও ঠোঁটে বসেনি, বসেছে আমার ঠোঁটে। কারণ ভীমরুলও আমাকে চেনে এবং আমেরিকান ভীমরুল।’
আড্ডার এ অধ্যায় এখন সমাপ্ত। সাঈদ আহ্মদ লোকান্তরিত হয়েছেন বাংলা নাট্যজগতে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে। আর আমরা প্রবাসীরা হারিয়েছি বাংলা সংস্কৃতির পরিশীলিত আড্ডার প্রাণপুরুষ।

No comments

Powered by Blogger.