আমার ভাষা আমার একুশ-একটি পূর্ণাঙ্গ অভিধান কবে পাব? by সৌরভ সিকদার

অভিধান হচ্ছে যেকোনো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির দলিল বা সংরক্ষিত রূপ। বাংলা ভাষায় অভিধান প্রণয়নের বয়স প্রায় তিনশ বছর হতে চলল অথচ এত দিনেও একটি পূর্ণাঙ্গ অভিধান আমরা পাইনি। ব্যাকরণের মতোই বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বা ধর্মযাজকের হাতে।


বিদেশিরা মূলত ধর্ম প্রচার, ব্যবসা-বাণিজ্য বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে এ দেশের ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা থেকে অভিধান বা শব্দকোষ রচনার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম এসেছিলেন পর্তুগিজরা। অভিধান রচনার প্রথম উদ্যোগ তাই তারাই নিয়েছিল। ঢাকার অদূরে ভাওয়ালের (গাজীপুর জেলা) নাগরি গ্রামে বসে ফাদার মানোএল দা আস্সুম্পসাঁও ১৭৩৪ সালে ‘ভোকাবোলারিও এম ইডিওমা বেঙ্গল-ই পর্তুগিজ’ অভিধান সংকলন করেন। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে পা-লিপিটি মুদ্রিত হয়। এটি পর্তুগিজ বাংলা প্রথম অভিধানই নয়, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থও। এরপর বাংলা-ফারসি শব্দকোষ (১৭৭৪-৭৫), ওগুস্তেঁ ওসাঁর, ‘বাংলা ফরাসি শব্দকোষ’ (১৭৯৯-), হেনরি ফস্টার, উইলিয়াম কেরি (১৮১৮), তারাপদ চক্রবর্তী (১৮২৭) প্রমুখের ধারাবাহিকতায় বিশ শতকে হরিচরণ এবং জ্ঞানেন্দ্র মোহন বাংলা অভিধানকে বেশ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। তবে একুশ শতকে এসে যে দুটি অভিধান বাঙালির নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল তার প্রথমটি কলকাতার ‘সংসদ’ দ্বিতীয়টি ‘বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। অভিধান নানা রকম হতে পারে, নানা প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে সংকলকেরা কখনো বানান, কখনো উচ্চারণ কখনো ব্যুত্পত্তি কখনো বা প্রয়োগ অভিধান সংকলন করে থাকেন। এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য একধরনের অভিধান বিশেষজ্ঞদের জন্য অন্য রকম। সুবীর রায় চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—‘অভিধানের পাঠক বিপুল ও বিচিত্র। সদ্য সাক্ষর থেকে বিশেষজ্ঞ সবাই অভিধান ব্যবহার করেন।... অনবরত নতুন শব্দ গৃহীত হচ্ছে। নতুন পরিভাষা তৈরি হচ্ছে। একজনের পক্ষে তার হিসাব রাখা অসম্ভব। বিরতিহীন সম্পাদনা ছাড়া অভিধান অচল’ (প্রসঙ্গ বাংলা ভাষা; ১৯৮৬)। আর এখানেই আমাদের সীমাবদ্ধতা। প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ না নিলে একটি সচল ভাষার পূর্ণাঙ্গ অভিধান সংকলন করা কখনোই সম্ভব নয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি বিশালায়তনের এ রকম একটি বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ অভিধান সংকলনের উদ্যোগ নিয়েছিল, বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কয়েকটি সভা- কর্মশালাও করা হয়েছিল, কিন্তু অর্থ-অনুদান বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ উদ্যোগ অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে।
বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ অভিধান সংকলনের বিষয়ে অভিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল কাইউম আমাদের জানান, ‘বাংলা ভাষায় অভিধান প্রণীত হয়েছে মূলত অভিধানপ্রণেতার বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে। এ কারণেই একটি অভিধানের সঙ্গে অন্যটির ভিন্নতা চোখে পড়ে। এমনকি অভিধানগুলোর শব্দ সংগ্রহ ও শব্দ সংকলনের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের এখন প্রয়োজন বাংলা ভাষার পূর্ণাঙ্গ অভিধান প্রণয়ন। এই অভিধানে সর্বস্তর বা শ্রেণী থেকে শব্দ সংগৃহীত হতে হবে। ফলে এর ব্যবহারযোগ্যতা বাড়বে। স্মরণ রাখা দরকার আমাদের লৌকিক ভাষা যেমন বাংলা, তেমনি আঞ্চলিক ভাষাও বাংলা। আর ঐতিহ্যগত দেশজ শব্দ তো রয়েছেই। তবে এ জাতীয় পূর্ণাঙ্গ অভিধান প্রণয়ন একক দায়িত্বে সম্ভব নয়।’
যেকোনো ভাষিক জনগোষ্ঠীর প্রত্যহিক ব্যবহারের ফলে অনেক শব্দই তাদের বিশুদ্ধ মৌলিক রূপ হারিয়ে নতুন মৌলিক রূপ গ্রহণ করে। এগুলোকে অশুদ্ধ ও প্রচলিত আখ্যা না দিয়ে অভিধানে যথাযোগ্য স্থান দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের অভিধানে সে রূপ শব্দ আশ্রয় বা ঠাঁই পায় না বলেই পূর্ণাঙ্গ অভিধান সংকলন হচ্ছে না। অভিধানকারেরা ভাষাকে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইলেও ভাষা সে বাঁধনকে উপেক্ষা করে আপন গতিতে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। এমনকি সময়ের ব্যবধানে একই শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মামা (মামু) এবং খালি। মামা শব্দ এখন শুধু মায়ের ভাই এবং খালি (রিকশা অর্থে) শূন্য অর্থে প্রয়োগ হয় না। অর্থাত্ এর অর্থ বদল ঘটেছে। একালে তরুণ সমাজে ব্যবহ্যত এরূপ দুটি শব্দের উদাহরণ হচ্ছে—‘চরম’ (খুব ভালো অর্থে প্রয়োগ হচ্ছে) এবং ‘কঠিন’ (সুন্দর অর্থে প্রয়োগ)। এগুলো বাংলা ভাষার কোনো অভিধানে নেই। অনুরূপ তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট অনেক নতুন নতুন শব্দ সংকলন না করলে বাংলা ভাষার অভিধান পূর্ণ হবে না। এ ছাড়া প্রচলিত অভিধানগুলোতে অভাব রয়েছে আইপিএসহ শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ বা সংকেতের, রয়েছে দৃষ্টান্ত বাক্যের অভাব, বানান পদ্ধতি নির্দেশ, শব্দের ব্যাকরণগত তথ্য-সন্নিবেশ এবং শব্দ প্রয়োগের স্তর (আগে প্রচলিত, বর্তমানে কোন স্তরে?) নির্দেশ প্রভৃতি। এসব বিচারে পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষার অভিধান আজও প্রণীত হয়নি। আধুনিক বাংলা অভিধান বিষয়ে ভাষা গবেষক অধ্যাপক নির্মল দাশ লিখেছেন, ‘আধুনিক বাংলা অভিধানপ্রণেতাকে এই দ্রুত-কালপ্রবাহের কথা মনে রাখতে হবে এবং বিজ্ঞান ও কারিগরিবিদ্যার অগ্রগতির ফলে মানব সংসারের রাষ্ট্রিক সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে তার দিকে দৃষ্টি রেখে নতুন অভিধানে নতুন নতুন শব্দকে সাগ্রহে ঠাঁই দিতে হবে। তার জন্য শুধু সাহিত্য নয়, সংবাদপত্র, প্রচার-পুস্তিকা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি আপাত-তুচ্ছ ক্ষেত্র থেকেও শব্দ খুঁটে নিতে হবে’।
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক তিন যুগ আগে ‘বাংলাদেশের প্রস্তাবিত অভিধান’ প্রস্তুতির নীতি তৈরি করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আধুনিক বাংলা অভিধান তৈরির আগে এর উদ্দেশ্য সম্পর্ক স্পষ্ট হতে হবে, এটি কার ব্যবহারের জন্য? স্কুলের ছাত্র? সাংবাদিক, অফিসের কেরানি নাকি ছাপাখানার লিপিকার (যিনি কম্পোজ করেন)? এদের জন্য যে অভিধান প্রণয়ন করা উচিত তা যেমন সহজ-সরল ও ছোট হবে, তেমনি বিশেষজ্ঞ-অধ্যাপক-গবেষকদের জন্য প্রণয়ন করতে হবে বৃহত্ কলেবরের সব প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী অভিধান। সবশেষে বলা যায়, বাংলা ভাষার অভিধান এখনো প্রথমিক স্তরেই রয়েছে। এই স্তর অতিক্রম করে কবে আমরা পূর্ণাঙ্গ বাংলা অভিধান পাব? বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির স্বার্থে এই দায়িত্ব কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে এবং সেটা বাংলাদেশ থেকেই।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.