বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-জনশক্তি রপ্তানিতে অচলাবস্থা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থাকলেও বহির্বিশ্বে আমাদের শ্রমবাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে- এটিই হলো বাস্তবতা। বিষয়টি সংগত কারণেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তার।


বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়া মানেই দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠী ও বিপুল কর্মহীনের এ দেশে রেমিট্যান্স লাভের পথে বড় বাধা এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির দিকটিও স্ফীত হয়ে ওঠে, যা মারাত্মক অশুভ বার্তাও বটে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সৌদি আরবের শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি গত তিন বছরের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ কম। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে সৌদি আরব থেকে দেশেফেরা শ্রমিকদের তালিকাও। সৌদি আরব বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার। গত তিন বছরে সৌদি আরবে আমাদের ৩৪ হাজার শ্রমিক গেলেও ফিরে এসেছে প্রায় ৫০ হাজার।
মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার চিত্র নিকট অতীত পর্যন্ত উজ্জ্বল থাকলেও ক্রমেই তা বিবর্ণ হচ্ছে। দুই বছর ধরে কুয়েতের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার নেই। মালয়েশিয়ার চিত্রও একই। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনশক্তি রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট আশানুরূপ নয়। পাশাপাশি গত তিন বছরে নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানে সরকারের তরফে যতটা তাগিদ দৃশ্যত পরিলক্ষিত হয়েছে, কার্যত এর বিপরীতে সুফল মেলেনি মোটেও। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় জোগানদার জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে যে উদ্বেগনজনক চিত্র এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা একদিনে সৃষ্ট নয়। বিপুল কর্মহীনের এ দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা-সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে এত কথাবার্তা, উদ্যোগ-আয়োজন নেওয়া হলেও ফল কেন প্রায় শূন্য, এটি জরুরি প্রশ্ন। সরকারের তরফে বারবার বলা হচ্ছে, শ্রমবাজার শক্তিশালী করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন মন্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল ব্যাপক। বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে যে সৌদি আরবের বিস্তৃত দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের দিকে, এখন তারা সে দৃষ্টি ফেলছে ভারত ও নেপালের দিকে। বাংলাদেশ থেকে শুধু জনশক্তি আমদানি কমানোই নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্র বদল (আকামা) করতেও দিচ্ছে না। ফলে সেখানে অসংখ্য বাংলাদেশি চরম বিপাকে পড়েছে।
একটি কথা শোনা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের কারণে সৌদি আরবের বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যাপারে এই অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। যদি এটি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে, এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার দাগটি খুব মোটা। কারণ সরকার তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছে, জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের আজ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম তো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। অথচ এই যুদ্ধাপরাধীরা ইসলামের নামেই বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংস ও বর্বরতম অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল একাত্তরে সংঘদ্ধবদ্ধভাবে এবং এরপর এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন বাংলাদেশেও। এই সত্য যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে নিশ্চয়ই তারা তা আমলে নিত এবং যুক্তিগ্রাহ্য এ বক্তব্য খণ্ডানোর মতো আগ্রহ তারা পরবর্তী সময়ে হয়তো আর দেখাত না। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে কতটা কী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তা অস্পষ্ট। এ তো গেল শুধু সৌদি আরবের ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের পুরনো অন্য শ্রমবাজারের দরজাও কেন সংকুচিত হলো কিংবা নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানে ব্যর্থতার খতিয়ানই বা কেন এত দীর্ঘ, এর যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মিলছে না শুধু উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ভিন্ন। গত ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতে শ্রমবাজার চাঙ্গা করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে দেশ সফর করার পরও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। লিবিয়ায় যে আশার আলো ফুটে উঠেছিল, তাও নিভে গেছে। লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এর জন্য কিছুটা দায়ী বটে; কিন্তু পুরোটা নয়। এর বাইরে নিকট অতীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ১৬টি দেশের তালিকা করে নতুন শ্রমবাজার সন্ধানের উদ্যোগ নিলেও কোনো সুফল তারা নিয়ে আসতে পারেনি।
দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানা রকম অপকর্ম করে এবং এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের শ্রমবাজারে- এই অভিযোগটিও নতুন নয়। সরকার এ ব্যাপারে কতটা কী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে এ নিয়েও আছে ধূম্রজাল। একই সঙ্গে দেশের কতিপয় অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকের নানা রকম তুঘলকি কাণ্ডও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাদের সম্পর্কে নানা মহল থেকে বারবার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হলেও সরকারের তরফে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকার ভিন্ন দৃশ্যত এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ক্রমেই দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। শ্রমিকদের দক্ষতা অর্জনের তাগিদও বারবারই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনমতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কতটা কী হয়েছে, এ নিয়েও কথা আছে। শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জন্য যখন অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে, তখন বিদ্যমান দুরবস্থাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাটিয়ে তোলার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নিবিড় হস্তক্ষেপের পাশাপাশি দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই জরুরি। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের অনেকের সম্পর্কেই নানা রকম কথা রয়েছে। মিশনগুলোতে কর্মরতদের বেশির ভাগেরই দক্ষতা, যোগ্যতা, দায়িত্ব-কর্তব্য পালন বোধ নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও তাঁদের সম্পর্কে ইতিমধ্যে বহুবার অভিযোগ উত্থাপন করেছে, কিন্তু প্রতিকার কতটা কী হয়েছে তাও অস্পষ্ট। মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে হাজার হাজার শ্রমিক চরম অমানবিক জীবনযাপন করলেও সেখানে তারা দূতাবাস কর্তাদের কোনো দেখাই পায় না। অন্য দেশের মিশনগুলোতে কর্মরতরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চললেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। বিভিন্ন দেশে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও নেপালের মিশনগুলোতে দায়িত্বরতরা কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন এবং সেসব দেশের সাম্প্রতিক জনশক্তি রপ্তানি চিত্র এরই সাক্ষ্যবহ।
জনশক্তি রপ্তানি হ্রাসের বিষয়টি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূলে কুঠারাঘাত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পাশাপাশি অস্থিতিশীল সমাজকে আরো বিষিয়ে তুলতে পারে। একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি খাতে শৃঙ্খলা কিংবা স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেনই শুধু প্রতিকার 'হবে'-'হচ্ছে'র মতো অদ্ভুত সংস্কৃতির জঞ্জালে আটকে আছে- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় সংশ্লিষ্ট মহল এড়াতে পারে না। আবারও বলতে হয়, এ খাত থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে শুধু বৈদেশিক মুদ্রাই আসছে না, দেশের কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটিও যথেষ্ট পুষ্ট হচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় সংকট। এত কিছুর পরও অস্ট্রেলিয়া থেকে সুখবর এসেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার দক্ষ ও আধাদক্ষ জনশক্তির বিশাল বাজার হতে পারে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ও উন্নত অর্থনীতির দেশ অস্ট্রেলিয়া। এ সম্ভাবনা যাতে হাতছাড়া না হয় সে জন্য চাই জোরদার উদ্যোগ। এ ব্যাপারে দূরদর্শী পদক্ষেপ দ্রুত দরকার। এখনো জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতে তা আরো ব্যাপকভাবে দেখা দেবে। জনসম্পদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর শক্তিশালী উদ্যোগ অবশ্যই অত্যন্ত জরুরি। জনশক্তি রপ্তানিতে যে ধস নেমেছে বা শনির দশা চলছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। সুষ্ঠু ও সমন্বিত জনশক্তি রপ্তানি নীতিমালার আলোকে একটি যৌক্তিক অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করাও জরুরি। কোনোভাবেই এ নিয়ে আর কালক্ষেপণ নয়।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.