ছাত্রের মৃত্যু-আবু বকরের রক্তে মাখা নোটখাতা by ফারুক ওয়াসিফ

‘চিঠিটা তার পকেটে ছিল, ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা’—বায়ান্ন’র এক ভাষা শহীদকে নিয়ে কবিতাটি লিখেছিলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। সন্তানহারা এক মায়ের ডুকরানো কান্না ফুটে উঠেছিল কবিতাটির পরতে পরতে। ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা’ বলে শুরু হয়েছিল।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকরের মায়ের পুত্রশোক নিয়েও সে রকম এক কান্নাকাতর কবিতা হতে পারে। সেটাও ছিল ফেব্রুয়ারি, এটাও ফেব্রুয়ারি। তখন বরকতরা মরেছিল, এখন মারা গেল আবু বকর। এক ভাষা শহীদের বুকপকেটে থাকা মায়ের কাছে লেখা চিঠিটা রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকরের নোটখাতাও ভিজল তারই দেহের রক্তে। তার মা-ও সে রকমই এক দরিদ্র গ্রামীণ নারী; কুড়ির পরেই সংসারের ঘানি যাঁদের বুড়ি করে ফেলে। জীবনের সব আশা-বাসনা সন্তানের জীবনের মধ্যে খোঁজা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাঁদের। তাঁরা গাছের ফলটা, বাড়ির মুরগিটা, মাচায় বাড়তে থাকা লাউটা ছেলে বাড়ি এলে খাওয়াবেন বলে রেখে দেন আর দিন গোনেন। কিন্তু ফল ঝরে যায়, মুরগিটা এমনি এমনি ঘুরে বেড়ায়, ছেলে বাড়ি আসে লাশ হয়ে।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট নিয়ে বিরাট মিছিল হয়েছিল ঢাকা শহরে। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ আর আবু বকরের রক্তমাখা নোটখাতা দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে চিত্কার করে প্রতিবাদ করছে তার সহপাঠীরা। রক্তে মাখা এই নোটখাতা, আমাদের ধূলায় লুটানো শিক্ষার আর আমাদের খোঁয়াড়বাসী জীবনের রক্তাক্ত দলিল। একটি প্রাণের মর্মান্তিক অপচয়ের দলিল। তাই আবু বকরের হত্যাকারীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বা পুলিশ বা যে-ই হোক, কেবল তাদের বিচার করলেই হবে না, শিক্ষাকে যারা সন্ত্রাসের কাছে বলি দিচ্ছে, যাদের জন্য উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হত্যা-মৃত্যুর লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, ক্ষমতা হাতে নিয়ে যারা উচ্চ শিক্ষার পতন চেয়ে চেয়ে দেখছে, তাদেরও বিচার হতে হবে।
সুন্দর ও পরিপাটি হাতের লেখায় ও মেধাবী মন্তব্যে ভরা ওই নোটখাতাটি তৈরি হতে অনেক রক্ত-ঘাম-ত্যাগ আর সাধনা লেগেছিল। ওই নোটখাতাটি পর্যন্ত পৌঁছতে আবু বকরকে দারিদ্র্য নামক এক অতল গহ্বর থেকে মাটি কামড়ে ধরে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে আসতে হয়েছিল। এর নাম জেদ এর নাম সংগ্রাম। এ পর্যন্ত আসতে তাকে কত শ্রম, কত রাত জাগা, কত অনাহার, কত অপমান সইতে হয়েছিল—তার কোনো পরিমাপ কেউ করতে পারবে না। আমরা কেবল জানলাম: ওর বাবা দিনমজুর, বড় ভাই মুদি দোকানদার, মা খরচ কমাতে বহু বছর চুলে তেল দেন না। আবু বকর যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের চৌকিতে ঘুমিয়ে ক্লাস করতে পেরেছে, কিংবা পেরেছে দেশের প্রধান উচ্চশিক্ষালয়ে বিচরণ করতে, তার পেছনে একটি গ্রামীণ পরিবারের বছরের পর বছরের সংগ্রামের বিনিয়োগ ছিল। অনেক বছরের রক্ত পানি করা শ্রমের ঘাম আর দুঃখের অশ্রুতে একটি আবু বকর তৈরি হয়েছিল। কেউ জানত না, এই ছেলেটি ছুটিতে ক্রিকেট খেলে বেড়ায় না বা চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারে না। তাকে তখন পড়ার খরচ জোগাতে কাজ করতে হয় প্রতিবেশীদের খেতখামারে। যেমনটা সে করে এসেছে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের গত কয়েক বছরে তার মতো ছাত্র আসেনি। এই যোগ্যতা নিয়ে আবু বকর শিক্ষক হতে চেয়েছিল, চেয়েছিল তার হতভাগ্য বাবা, হতভাগিনী মা আর ভাইবোনদের ত্যাগের প্রতিদান দিতে। তার জন্য সেটা ছিল এভারেস্ট বিজয়ের মতোই কঠিন আর গৌরবের। কিন্তু প্রায় চূড়ায় পৌঁছেই সন্ত্রাসের থাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে যেখানে ফেলে দিল, সেখান থেকে আর কোনো দিন সে উঠতে পারবে না। ও ছিল পুরো পরিবারের চোখের মণি, ওকে হারিয়ে পরিবাটি জীবনের জ্যোতি হারিয়ে ফেলল।
কিন্তু কার দোষে? শিক্ষাকে জাতির আলো, মেরুদণ্ড ইত্যাদি বলে থাকেন নেতানেত্রীরা। নিরক্ষরদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়া নাকি রাষ্ট্রের পবিত্র কর্তব্য। এ রকম একদম তলা থেকে এক দরিদ্র বালকের উঠে আসা বিরাট সাফল্য হলেও তা শিক্ষা ব্যবস্থার সাফল্য নয়! আবু বকর’রা কারো সাহায্য ছাড়াই একা একাই সেই আলো জ্বালায়, সেই মেরুদণ্ড সবল করে। তার বয়সী আরো অনেক গ্রামীণ আবু বকর লুঙ্গি পড়ে নিজ উদ্যোগে বিদেশে যায়, শ্রম বেচে কষ্টার্জিত ডলার পাঠায়। সেই ডলার দিয়েই তো বিদেশী গাড়ি আসে, বিদেশী ঋণ শোধ হয়; নেতা-নেত্রী-আমলা-কোটিপতিদের অনেকে বিদেশে যান কেনা-কাটা করেন ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ান বিদেশে বাড়ি করেন কিংবা বিদেশি ব্যাংকে ডলার জমান। আর প্রবাসী শ্রমিকরা ফেরে লাশ হয়ে, আবু বকর’রা বাঁচতে পারে না।
গ্রিক পৌরাণিক বীর একিলিসের গোটা দেহ দেবতাদের বরে সুরক্ষিত থাকলেও পায়ের গোড়ালি ছিল অরক্ষিত। সেই গোড়ালিতেই তীর বিঁধে তাঁর মৃত্যু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে ক্ষমতাসীনদের একিলিসের গোড়ালি; এখানে আঘাত লাগলে সেই আঘাত বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। আবু বকরের মৃত্যু জনপ্রিয় ভোটে আসা সরকারের গোড়ালিতে তেমনই এক তীর।
সাধারণ ছাত্ররা তাঁদের সহপাঠীর করুণ মৃত্যুতে কঠোর হয়েছে। তাঁরা হল ছেড়ে ক্লাস বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়েছেন। ছবি অনেক কথা বলে। এই ছবি আমরা দেখেছি গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গভীর রাতে শামসুন্নাহার হলে পুলিশের হামলার পর শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে, দেখেছি জরুরি অবস্থার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-বিক্ষোভের দিনগুলিতে। ঐ দুটি ঘটনা ঐ দুই সরকারের নৈতিক ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারি দলের কারো অন্যায়ের কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামে, বুঝতে হবে সেই সরকারের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
যে কোনো মৃত্যুই শোকের ও প্রতিবাদের। আবু বকর গরিব ও মেধাবী ছিল বলেই নয়, সে নিরপরাধ ছিল। তার মৃত্যুর জন্য সরাসরি যারা দায়ি তাদের খুঁজে বের করাও কঠিন কিছু নয়। সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনগুলো আকাশ থেকে নামেনি। কারা তাদের পেলে-পুষে টিকিয়ে রাখে তা পুলিশ জানে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে, জনগণও জানে। তারপরও কর্তাব্যক্তিরা জেনেও না জানার ভান করেন, আর মিডিয়া খুব চেপে ধরলে ভাওতা হিসেবে দু-একটা চুনোপুটি ধরা হয়। এবং সন্ত্রাস রয়ে যায় অক্ষয় হয়ে। কারণ সন্ত্রাস ও পেশীশক্তি ছাড়া বিদ্যমান অর্থনীতি ও রাজনীতি সুবিধা করতে পারে না। টেন্ডারবাজি, ভূমিদস্যুতা, চোরাকারবারি-কালোবাজারি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বশে রাখা, এলাকায় দাপট জারি রাখা, শ্রমিককে ভয় দেখানো, জোর করে বা টাকা দিয়ে মিছিলে লোক আনানো, সংবর্ধনা দেওয়ানো ইত্যাদি বহু কারণে সন্ত্রাসী বাহিনী লাগবেই। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কায়কারবারের খুব কম ক্ষেত্রই আছে যেখানে পেশীশক্তি না হলেও চলে। অন্যদিকে সন্ত্রাস বেকারদের বিকল্প কর্মসংস্থানও। তাই রাজনীতি ও অর্থনীতি সুস্থ ও সঠিক দিশায় না এলে সন্ত্রাস কমতে পারে না। এই কাজ কঠিন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংকল্প নিয়ে এগুলে জনগণকে সাথে নিয়ে তা করা সম্ভব। কিন্তু তা হয় না, কারণ মানুষ যতটা বদল চায় ততটা বদল ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তিগুলো চায় বলে মনে হয় না। যদি চাইতো, দেশটা সকল আশার সমাধিক্ষেত্র হতো না, দিনে দিনে একটু একটু করে এগতো। সন্ত্রাসের পুরনো ভূত আজো দাপিয়ে বেড়াতে পারতো না।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু যেকোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি স্পর্শকাতর বিষয়। অথচ সেই স্পর্শকাতরতা মনে হয় আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের নেই। তিনি এই মৃত্যুকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলেছেন। বলেছেন, ‘এটা কোনো ব্যাপার না, এমন ঘটতেই পারে।’ না মাননীয়া মন্ত্রী, এটা ঘটতে পারে না এবং এমন কথা আপনি বলতে পারেন না। আপনার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেউ সন্ত্রাসীর হাতে মারা গেলে বা কাউকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া হলে তার দায় আপনারই। অথচ আপনি ‘ক্রসফায়ার’ সমর্থন করছেন আর এক মাসুম ছাত্রের মৃত্যুতে বলছেন, ‘এটা ঘটতেই পারে’! আমরা তাহলে কোথায় যাব? যদি ‘এটা ঘটতেই পারে’ তাহলে এমন মৃত্যুও ঘটতেই থাকবে! তাহলে বলতে হয়, এ দেশে শিক্ষার মূল্য নেই, কান্নার মূল্য নেই, প্রতিবাদের মূল্য নেই, জীবনেরও মূল্য নেই। এখানে জীবন খোঁয়াড়ের, ক্ষমতা অমানবিকতার।
আবু বকরের রক্তমাখা নোট খাতার সামনে নত হয়ে সরকারকে এসব জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হবে। এবং তা দিতে হবে তার কবরে ঘাস গজিয়ে ওঠার আগেই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.