আমার ভাষা আমার একুশ-বাংলা পরিভাষা: নতুন কোনো নির্মাণ নেই by সৌরভ সিকদার

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের কৃষিকাজের জন্য ‘গভীর নলকূপ’ ব্যবহার করে। এই গভীর নলকূপটি যে ইংরেজি ‘ডিপটিউবওয়েল’ থেকে এসেছে, পরিভাষা হিসেবে তা তারা জানে না। বাংলা ভাষার ভান্ডারে নতুন শব্দ এল, বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তা গ্রহণও করল। এভাবে পরিভাষা তৈরি হয়, ভাষা সমৃদ্ধ হয়।


একসময় বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র কম ছিল, তাই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছাড়া পরিভাষা তৈরির প্রয়োজন ও সুযোগ ছিল না। একালে বিশ্বায়নের (গ্লোবালাইজেশনের পরিভাষা) ফলে পৃথিবীর তাবত্ প্রযুক্তি, জ্ঞানশাখা, ভোগ্যপণ্য রাতারাতি চলে আসছে আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু ভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে এবং বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের মাঝে তা বোধগম্য করে ছাড়িয়ে দিতে যথেষ্ঠ পরিভাষা তৈরি হচ্ছে না। অথচ আমরা চাই আমাদের মাতৃভাষা জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন নতুন বই থেকে শুরু করে প্রযুুক্তির ব্যবহার, কথাবার্তায় এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্মে সর্বস্তরে প্রসারিত হোক। ১৯৩৩ সালে রাজশেখর বসু বলেছিলেন, ‘পরিভাষার একমাত্র উদ্দেশ্য বিভিন্ন বিদ্যার চর্চা এবং শিক্ষার বিস্তারের জন্য ভাষার প্রকাশশক্তি বর্ধন। পরিভাষা যাতে অল্পায়াসে বোধগম্য হয়, তাও দেখতে হবে।’
আমাদের অফিসে অফিসে ফাইলের সঙ্গে ‘নথি’ চলে কিন্তু নোটের সঙ্গে কী চলবে? কেউ লিখছেন ‘টোকা’, কেউ বা ‘চোথা’। উপযুক্ত শব্দ বা পরিভাষার অভাবে থমকে যেতে হচ্ছে। পরিভাষা যথাযথ না হলে যেমন বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়, তেমনি সাধারণ মানুষ তা ব্যবহারও করে না। যেমন উনিশ শতকে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের পরিভাষা করা হয়েছিল অম্লজান ও উদ্জান—ওগুলো চলেনি। তেমনি পাকিস্তান আমলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ইংরেজ চিকিত্সক বার্নাড প্রথম সফলভাবে ‘হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন’ করলে তখনকার দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হরফে খবরটি লেখা হয়েছিল ‘হূদয়-বদল’ শিরোনামে। সংবাদপত্রে এমন একটি যুগান্তকারী সংবাদ বা বৈজ্ঞানিক সাফল্য শুধু লাগসই পরিভাষার অভাবে প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে রূপান্তরিত হয়েছে।
কাজেই উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দের অভাবে বাংলায় যে সবকিছু স্পষ্ট করা যাচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের বাংলা সাহিত্য অর্থাত্ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক হয়তো পরিভাষার মুখাপেক্ষী নয় (অবশ্য অনুবাদ সাহিত্যের প্রয়োজন আছে)। কিন্তু বিজ্ঞান, বাণিজ্য, দর্শন, চিকিত্সা, প্রকৌশল বিদ্যা, আইন শাস্ত্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত এবং সংবাদমাধ্যমগুলোতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করতে গেলে পরিভাষার সমস্যা আসবেই। সে কারণেই প্রয়োজন উপযুক্ত পরিভাষা। প্রয়োজনটা যাদের, তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যদিও পরিভাষা তৈরিতে সাধারণ মানুষ অনেক আগেই অবদান রেখেছে। ভাষা বিশারদ মুহাম্মদ এনামুল হক এ প্রসঙ্গে তিন যুগ আগে লিখেছেন—‘দেশের গণমানব বাংলা মুদ্রাক্ষর যন্ত্রের খবর রাখে না, বাংলা পরিভাষা তৈরিরও তোয়াক্কা করে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই বাংলা ভাষার মূল ধারক ও বাহক। তাদের কাজ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় পরিভাষা তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে ও নিচ্ছে’ (মনীষা-মঞ্জুষা; ১৯৭৬) তিনি এগুলোকে লৌকিক পারিভাষিক শব্দ উল্লেখ করে কিছু দৃষ্টান্তও দিয়েছেন: অ্যারোপ্লেন>উড়োজাহাজ, রেডিও>বেতার, কন্ট্রাক্টর>ঠিকাদার, বোম্ব>বোমা, ইঞ্জিন>ইঞ্জিল, ভোটিং>ভোটাভুটি, জেনারেল>জাঁদরেল প্রভৃতি। মুহাম্মদ এনামুল হক পরিভাষা নিয়ে তেমনি অভিযোগও করেছেন, ‘আর শিক্ষিত লোকেরা কোনো বিদেশি বৈজ্ঞানিক শব্দের কোনো বাংলা শব্দ তৈরি না করে শুধু ইংরেজি তথা বিদেশি ভাষাকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছেন।’ প্রয়াত ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ একে অন্যভাবে বলেছেন, ‘কত টাকা জমলে বাংলাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয়।’ বাংলাদেশে পরিভাষা নিয়ে কাজ করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা। তিনি বাংলায় পরিভাষার সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে জানান, ‘বাংলা পরিভাষা পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয় সম্বন্ধে বলতে গেলে তিনটি পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে। একটি হচ্ছে পরিভাষা বা পরিশব্দ সৃষ্টি পরিস্থিতি, দ্বিতীয়টি হলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিশব্দ প্রচার-পরিস্থিতি, তৃতীয়তটি হলো পরিভাষা ব্যবহারকারীর আগ্রহ।
প্রথমত. বাংলা একাডেমী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যা পরিভাষা বা পরিশব্দ সৃষ্টি করেছে তা জ্ঞানচর্চার জন্য যথেষ্ট নয়। সব শব্দ এক দিনে সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু যা সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ বিতরণ ও ব্যবহারও হচ্ছে না। ফলে পরিভাষা পরিস্থিতি যতটা স্বভাবমুখী হওয়া উচিত ছিল, ততটা স্বভাবমুখী না হয়ে বিভাষামুখী হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক পরিভাষা কমিটিগুলোতে আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব কিংবা অংশীদারি নেই। এমনকি ভাষিক এলাকা হিসেবে উপমহাদেশের পরিভাষা পরিস্থিতি খুব সন্তোষজনক নয়। সার্ক অঞ্চলে একটি পরিভাষা সমতা কমিটি গঠন একান্ত প্রয়োজন।
উনিশ ও বিশ শতকে পরিভাষা প্রণয়নে ব্যক্তিপর্যায়ে অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ এরং প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সাহিত্য পরিষত্ পত্রিকা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমী প্রভৃতির অবদান অস্বীকার্য। বিশেষ করে—সাহিত্য পরিষত্ পত্রিকা। এই পত্রিকায় ১৯০১ সাল থেকে প্রায় ত্রিশ বছরে ৬৭টি পরিভাষা বিষয়ক লেখা এবং নানা জ্ঞানশাখার পরিভাষা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ একুশ শতকে এসে আমাদের পরিভাষা প্রণয়ন প্রচেষ্টা থমকে গেছে যেন।
একুশের চেতনাকে সমুন্নত করে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হলে আমাদের পরিভাষা তৈরির বিকল্প নেই। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যেমন বাংলা একাডেমী নিতে পারে, তেমনি যাঁরা যে শাস্ত্রের বা জ্ঞানশাখায় পণ্ডিত, তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। আসতে হবে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, গবেষকদেরও। আর এ ক্ষেত্রে ভাষিক সৌন্দর্য ও শুদ্ধাশুদ্ধির জন্য সহায়তা প্রয়োজন হবে ভাষাবিজ্ঞানীদের। নতুন পরিভাষা না হলে ভাষা সমৃদ্ধ হবে না। জ্ঞান শাখার বিস্তার ঘটবে না। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের দায়িত্বও কম নয়। ভাষার প্রতি দায়িত্ব পালন না করে কেবল ফেব্রুয়ারি এলে, ‘মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা’ আউড়ে কী লাভ?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.