বন্ধুর মাধ্যমেই মাদক জগতে ঢুকছে বেশিরভাগ তরুণ by সুমন তালুকদার

মাদকের অপব্যবহারের বড় শিকার হলো দেশের তরুণসমাজ। বন্ধুদের মাধ্যমেই মাদকের জগতে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা শতকরা ৭৩.৫৩ ভাগ। দিনের পর দিন বেড়েই চলছে এ সংখ্যা। বন্ধুদের পাল্লায়, জ্ঞানের অভাব কিংবা  কৌতূলের বশবর্তী হয়ে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তরুণরা, হয়ে উঠছে মাদকাসক্ত।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী কঠোর আইন থাকা স্বত্ত্বেও মাদকনির্ভর লোক ও মাদক পাচারকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়লেও সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। আর  এ কারণে মাদকের জগতের একের পর এক প্রবেশ করেছে ইয়ারা, সিসা জাতীয় মাদক। 
অন্যদিকে মাদক পাচার চক্র বিভিন্ন সময় তাদের কর্মকৌশলও পরিবর্তন করে আসছে। মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক পাচারের সুবিধার্থে নারী ও শিশু-কিশোরদের কাজে লাগাচ্ছে।  যেসব নারী বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত, এমনকি অনেক যৌনকর্মী মাদকের ট্রানজিট বা বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রোমান (ছদ্মনাম)। বয়স ২২ বছর। পড়াশুনা অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত। ঘনিষ্ট এক বন্ধুর মাধ্যমে মাদকের সাথে প্রথম পরিচয়; তারপর থেকে নিয়মিত মাদক গ্রহণ। গাঁজার সাথে প্রথম পরিচয় হলেও নিয়মিত হেরোইন সেবনে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। এ কাজে প্রতিদিন তাকে গুনতে হয় ১২০ থেকে ১৫০টাকা।

হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বাবা দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারলেও মাদকের জগত থেকে বের হতে পারে নি ছেলে রোমান। টাকা যোগাড় করতে এক সময় জড়িয়ে পড়ে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, চুরিসহ অপরাধমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। পরিত্রাণ পেতে সিলেটের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছে রোমান। শুধু রোমান নয়, বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে এ অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছে ৭৩.৫৩ ভাগ।

মাদকাসক্ত যুবকদের ওপর করা গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লে¬খ করা হয়েছে, যুবকরা তার নিজস্ব এলাকার পরিবেশ, পরিবার কর্তৃক অসমর্থন বা অবহেলা, বেকারত্ব, ব্যর্থ প্রেম, আত্ম নিয়ন্ত্রণের অভাব ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্ত হয়।

ওই গবেষণায় ঢাকা শহরে মাদকাসক্তের উপর করা একটি জরিপের কথা উল্লেখ করা হয়। ৫৬১ জনের উপর পরিচালিত এ জরিপে শতকরা ৫১.৯ ভাগ নেশাকারী নেশার জগতে প্রবেশ করে বন্ধুদের সাথে মিশে। ঢাকাতে পরিচালিত এ গবেষণা তথ্য মতে, ৫৬১ জনের মধ্যে ৪১৬ জন নেশাকারী মাঝে মাঝে নেশাবন্ধ করার চেষ্টায় ক্লিনিকে, কেয়ার পরিচালিত ক্যাম্প, নিরাময় কেন্দ্র  বা অন্যান্য উপায়ে চেষ্টা করেছে। এই ৪১৬ জনের মধ্যে আবার ১৪৭ জন আবারও নেশার জগতে ফিরে গেছে, যেখানে নেশার সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল এবং নেশাকারী বন্ধুদের অবস্থান বিদ্যমান ছিল।

একাধিক সূত্র জানায়, মাদকের সহজলভ্যতার কারণেই বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। ভারত সীমান্ত দিয়ে অবাধে হাতের নাগালে চলে আসছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। বিভিন্ন স্পট থেকে যুবকদের জন্য মাদকদ্রব্য ক্রয় করা সহজ হওয়ার মাদকের প্রতি তাদের আসক্তি বাড়ছে। আর এ কারণেই মাদকের প্রতি বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়ে সে পুরো মাদকাসক্তে পরিণত হয়ে উঠে। আর এ মাদকদ্রব্য ক্রয় করতে প্রয়োজনীয় টাকা যোগাড় করার জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধমূূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে মাদকাসক্তরা। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ সংখ্যা ৮২.৩৫ ভাগ। 

গবেষণায় আরও দেখা যায়, বেশির ভাগ মাদকনির্ভর লোকের পছন্দ হেরোইন। এর ধোঁয়া গ্রহণ করে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা। এরপর হলো গাঁজা বা ক্যানাবিস। তরুণ ও শ্রমজীবী মানুষের বেশি পছন্দ গাঁজা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাঁজা সেবনের অভ্যাস রয়েছে। তরুণ-তরুণীরা, মন ও শরীরে শিথিলতা আনার ইচ্ছায় সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ভরে তা সেবন করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, যখন বিশ্বে জন সংখ্যা ৫০০ কোটি ছিল তখন ৫০ কোটি মানুষ মাদকে আসক্ত ছিল। মাদকাসক্তি সমস্যা প্রথমে উন্নত বিশ্বে উদ্ভব হয়, আর তা কালক্রমে ছড়িয়ে পরে উন্নত এবং অনুন্নত দেশ সমূহে। মাদকের কারণে শুধুমাত্র আমাদের যুবসমাজ বা তাদের পরিবারই বিপর্যস্ত হচ্ছে না, তার সাথে তা সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও।

মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন ও সুস্থ করতে বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্র কাজ করলেও তাদের অন্ধকার জীবন থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন বলেন, বেকারত্ব, দারিদ্র, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যতা, ব্যক্তিগত সমস্যা, অস্থিরতা, পারিবারিক অবহেলা, কৌতুহল, ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, সন্তানের প্রতি পিতা মাতার নিয়ন্ত্রণের অভাব, সামাজিক বিশৃংখলাসহ নানা কারণে এ জগতে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা।

সরকারের কড়া নজরদারি এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ এ থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ঢাকা মেট্রোর সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান বাংলানিউজকে জানান, তারা মাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সচেতনতামূলক কমসূচির আয়োজন করছেন। এরপরেও মাদকের সহজলভ্যতা ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি ইয়াবার উদাহরণ দিয়ে বলেন, এটি পরিবহণ করা সহজ। প্যান্টের পকেটেই ৫০০ পিস ইয়ারা বহন করা যায়। এদেরকে সনাক্ত করা কঠিন হওয়ায় এ মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ছে আনাচে-কানাচে।

পাশাপাশি লোকবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযানে ভাটা পড়ে বলে উল্লেখ করে তিনি মাদকের ব্যবহার ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার তাগিদ দেন ।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা.বদিউস সালাম রিয়াদ বলেন, যারা মাদক গ্রহণ করে তাদের লিভার ক্যান্সার অথবা ব্রেইন অকার্যকর হয়ে যায়। মনের শিথিলতা আনতে অনেকেই মাদক গ্রহণ করলেও তারা জানে না এর ভয়াবহতা সম্পর্কে। মাদকাসক্তদের এ রাস্তা থেকে ফেরাতে চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সার্পোট এবং সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষার কথা বলেন তিনি। 

সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার বলেন, বন্ধুর সংস্পর্শ, পারিবারিক অবহেলা, কৌতুহলতাবশতসহ বিভিন্ন কারণে অনেকই মাদকাসক্ত হয়ে উঠে। মাদকাসক্তরা নিজের স্বাভাবিকতা হারিয়ে সামাজিক দায়দায়িত্ব ভুলে কল্পনার জগতে বাস করে। আর এ কারণে অপরাধ বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে এদেশের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরাই মদদ যোগাচ্ছে। অথচ নিম্ন শ্রেনীর লোক যারা অল্প পারিশ্রমিকে মাদকদ্রব্য হস্তান্তর করছে তাদেরকেই শাস্তির আওতায় আনা হয়। তবে সেটাও সব সময় নয়।

তিনি আরো বলেন, মাদকের কারণেই আমাদের সমাজে ৮০ শতাংশ অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটছে। সমাজ পুরোপুরি মাদকমুক্ত করতে পারলেই অপরাধ এমনিতেই কমে যাবে।

পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে তাদেরকে হেয়ভাবে না দেখে আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাদের সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.