খোলা চোখে-ভারত-বাংলাদেশ: আমার তিন পয়সা by হাসান ফেরদৌস

গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ওবামা নেকড়ের গুহায় পা রেখেছিলেন। শুধু পা রাখাই নয়, ঘণ্টাদুয়েক ধরে সেখানে বেশ খোশগল্পও করে এলেন। নেকড়ের গুহা মানে বালটিমোরে রিপাবলিকান পার্টির সাংসদদের এক বার্ষিক অনুষ্ঠান। আমন্ত্রণ রিপাবলিকানদের তরফ থেকেই এসেছিল।


এই মুহূর্তে ওবামা বেশ চাপের মুখে রয়েছেন, তাঁর জনপ্রিয়তা এখন তলানির দিকে। অনুষ্ঠানে তাঁকে খুঁচিয়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার ইচ্ছা ছিল রিপাবলিকানদের। প্রস্তাব করতেই ওবামা এককথায় রাজি। শুধু তাই নয়, তিনি আগ বাড়িয়ে বললেন, অনুষ্ঠানে তিনি যখন বক্তব্য রাখবেন, তখন টিভিতে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হোক। এ প্রস্তাব পেয়ে রিপাবলিকানরা প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায়। এ আবার ওবামার কোনো চাল নয়তো? প্রতিপক্ষের অনুষ্ঠানে এর আগে কোনো প্রেসিডেন্ট যে এসে বক্তৃতা করেননি তা নয়, কিন্তু সে তো তৈরি লেখা পড়ে দেওয়া। কিন্তু সরাসরি প্রশ্নোত্তর, তাও ‘তাজা’ টিভি সম্প্রচারের সময়, এককথায় অভূতপূর্ব। শেষ পর্যন্ত ওবামার চাপাচাপির কারণেই সভাঘরে টিভি এল। রিপাবলিকানরা অবশ্য তৈরিই ছিল রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে। ভদ্র ভাষায় হলেও খুব কঠিন ছিল তাদের প্রতিটি প্রশ্ন। ওবামা কথা দিয়েছিলেন তাঁর প্রশাসন স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত হবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে যে প্রস্তাব আলোচিত হয়েছে, তাতে রিপাবলিকানদের কথা বলার কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি। বলেছিলেন, তাঁর প্রশাসনে লবিস্টদের কোনো জায়গা হবে না, সে কথাও সত্য প্রমাণিত হয়নি। তিনি ক্ষমতায় আসতে না আসতেই সরকারের আয়তন বাড়িয়েছেন, জাতীয় ঋণ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, বেকারত্বও দশ শতাংশের ওপরে। এসব আর যাই হোক, যে পরিবর্তনের তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কোনোটাই নয়।
ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্ন শুনলেন ওবামা এবং প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন। অঙ্ক করে বুঝিয়ে দিলেন কেন অর্থনীতির এই হাল, এর জন্য কতটা তিনি দায়ী, কতটা বিগত প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার ফল। রিপাবলিকানরা এখন দ্বিপাক্ষিকতার কথা বলছেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে সব প্রশ্নে এককাট্টা হয়ে না বলার গোঁ ধরেছেন তাঁরা। গোড়া থেকেই তাঁরা যেভাবে ওবামাকে শত্রু বানিয়ে বসে আছেন, তাতে আলাপ-আলোচনার কোনো পথ তারাই খোলা রাখেননি। তাঁকে ‘বলশেভিক’ নেতা বলে দেখানো হয়েছে, অথচ অর্থনীতি প্রশ্নে তাঁর প্রস্তাবিত নীতিমালার অনেক কিছুই সেই রিগান আমল থেকেই রিপাবলিকানরাই নানা সময়ে উত্থাপন করেছেন।
প্রেসিডেন্ট নয়, যেন কলেজ শিক্ষক ছাত্রদের সিভিক্সের ক্লাস নিচ্ছেন। মুখে হাসি, কিন্তু প্রতিটি কথা যেন মিছরির ছুরি। আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট এভাবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যুক্তি-তর্কে অবতীর্ণ হলেন। একে তুলনা করা হচ্ছে বিলাতের পার্লামেন্টে ‘প্রাইম মিনিস্টারস আওয়ার’-এর সঙ্গে। সেখানে প্রতি বুধবার দেশের প্রধানমন্ত্রী আধাঘণ্টা সময় ব্যয় করেন পার্লামেন্টে সরাসরি প্রশ্নোত্তরে। যে যা খুশি প্রশ্ন করতে পারেন, তাও টিভি ক্যামেরার সামনে। আমেরিকায় সেই একই কাণ্ড হবে, এ কথা স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। সবাই মানেন, গত এক বছরে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক তিক্ত হয়ে উঠেছে। তার জন্য দোষ একা রিপাবলিকানদের নয়, ওবামা স্বীকার করলেন কিছুটা তাঁর ও তাঁর দলের নেতা-নেত্রীদেরও রয়েছে। তিনি এ কথাও স্বীকার করলেন, রিপাবলিকানদের সব প্রস্তাবই ফালতু নয়। দুই পক্ষই যদি দেওয়া-নেওয়ার মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসে, তাহলে সমঝোতায় আসা অসম্ভব নয়। কিন্তু রিপাবলিকানরা যদি গোঁ ধরে বসে থাকেন, তাঁরা যে প্রস্তাব দেবেন তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে, তাহলে সে চেষ্টা অর্থহীন।
অনেকেই বলছেন, নেকড়ের গুহায় ঢুকে ওবামা রীতিমতো ক্যু করে এসেছেন। কেউ কেউ আশা করছেন, সম্ভবত কিছুটা কল্পনার ফানুস ছড়িয়ে, ওবামার এই খোলামেলা আলোচনার ফলে আমেরিকার চলতি রাজনৈতিক তিক্ততা কিছুটা হলেও কমবে। হাতটা যে ওবামাই প্রথম বাড়িয়েছেন, সেটাই হয়েছে কাজের কাজ। এখন তাঁর দলের নেতা-নেত্রীদেরও একই মনোভাব দেখাতে হবে। দেশটা তো সবার, ফলে রাজনীতি কিছুটা দূরে সরিয়ে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া যায়, এমন ন্যূনতম কর্মসূচি নিয়ে যদি এগোনো সম্ভব হয়, তাহলে রাজনীতির উল্টোস্রোত ঠেকানো সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু এর পরও যদি রিপাবলিকানরা গোঁ ধরে বসে থাকেন, সব ব্যাপারেই ‘না-না’ বলতে থাকেন, তাহলে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা যুক্তি দেখাবেন, এই দল কেবল জানে বাগড়া দিতে। তাদের জন্য রাজনীতিই শেষ কথা, দেশের স্বার্থ নয়।
ভারত-বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি ওবামার ‘মিনি ক্যু’র কথা কেন বলছি? বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে আমেরিকার রাজনীতির এক জায়গায় মিল রয়েছে, এ কথা আমি আগেও লিখে জানিয়েছি। বালিতে মাথা ডুবিয়ে না দেখার ভান করার ব্যাপারে আমেরিকার ও বাংলাদেশের বিরোধী পক্ষ যেন রসুনের গোড়া। দুই দেশেই প্রধান বিরোধী দলের মুখে কেবল ‘না-না’। সরকার থেকে যে প্রস্তাবই আসুক, তা নিয়ে বিচার-বিবেচনার আগেই তারা আগ বাড়িয়ে ‘না’ বলে বসে আছে। এই ‘না’-এর সংস্কৃতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমেরিকার কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ শেষ করাই অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের পর এখন দেখা যাচ্ছে, সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের ষাটটি ভোট নেই, আর ষাট ভোট না পাওয়া পর্যন্ত রিপাবলিকানরা পদ্ধতিগত আইন দেখিয়ে এই প্রস্তাব পাস হওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারেন। বাংলাদেশে অবশ্য ভিন্ন সমস্যা। প্রথম দিন থেকেই সংসদ বয়কট করার ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছে বিরোধী পক্ষ। অনুমান করি তাদের বিশ্বাস, এই বয়কটের ফলে একসময় সরকারের মাজা ভাঙবেই। আমেরিকায় ‘না-না’ বলে চেঁচিয়ে রিপাবলিকানরা কমবেশি ভালো ফল পেয়েছেন। বাংলাদেশেও বিরোধী দল সে পথই গ্রহণ করেছে। অনুমান করি, তাদের উভয়ের জন্যই সরকারের মাজা ভাঙাটাই আসল কথা, দেশকে সামনে আগানো নয়।
ওবামা বালটিমোরে যে কাজটি করলেন, তাঁর মতো বাংলাদেশের রাজনীতির বেয়াড়া রকম ‘লগজ্যাম’ ভাঙতে প্রথম উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে। গাছের মগডালে তাঁরা তো বসেই আছেন, এখন নিচের দিকে হাত দুখানা বাড়ালে সম্মানের হানি হবে না, বরং বাড়বে। পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁরা যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কোনো বিরোধী অংশগ্রহণ ছাড়াই, কোনো না কোনো সময় তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। বৈধতার অর্থাত্ লিগ্যালিটির প্রশ্ন নয়। আইনি বৈধতা তাঁদের থাকলেও বিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতির কারণে কোনো না কোনো সময় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের ‘লেজিটেমিসি’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশেষত যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। গত ১৫-২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এমন পটপরিবর্তন বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ঘটে আসছে। ফলে বিরোধী পক্ষকে পার্লামেন্টের ভেতর বসাতে পারলে সরকারের লাভ, দেশেরও লাভ।
এই মুহূর্তে সরকারের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন। মাসখানেক আগেও বিরোধী পক্ষের হাতে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার মতো কোনো শক্ত ‘ইস্যু’ ছিল না। মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুত্ ঘাটতি, আইনশৃঙ্খলা—এসব সমস্যা আগেও ছিল, এখনো আছে। এসব সমস্যা এত পুরোনো যে, মোটামুটি সহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলেই দেশের মানুষ সরকারকে পরীক্ষায় ‘পাস নম্বর’ দেবে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটি কিছুটা ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’। জুজুবুড়ি বলে কিছু নেই, কিন্তু জুজুবুড়ির ভয় অনেকের মনেই আছে। যেমন আছে ধর্মের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা। এই দুই প্রশ্নের যেকোনো একটির ব্যাপারে আমাদের মনের ভয়কে চাঙ্গা করে তুলতে পারলেই কিন্তু বিরোধী পক্ষের কাজ হয়ে যায়। যে কাজ তিন বছর পার্লামেন্ট বর্জন করেও অর্জন সম্ভব নয়, ওই এক জুজুর ভয় দেখিয়ে সে কাজই হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব। সত্যি সত্যি সম্ভব হোক বা না হোক, বিরোধী পক্ষের এমন একটা বিশ্বাস আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর থেকেই তাঁদের সব প্রচার-প্রচারণা যেভাবে এই এক ইস্যুকে ঘিরে ধূমায়িত হচ্ছে, অনুমান করি, বিরোধীপক্ষ ভাবছে, আলাদিনের চেরাগ এবার তাদের হাতের মুঠোয়।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা মোটেই হাল্কা করে দেখার নয়। কানাডা বা মেক্সিকো যেমন চাইলেই আমেরিকাকে উপেক্ষা করতে পারে না, আমরাও তেমনি ভারতকে এড়িয়ে চলতে পারি না। ভারত আমাদের শত্রু, এমন একটা ধারণা দিয়েও আমরা পার পাব না। কারণ, চাই বা না চাই, এই ‘শত্রুর’ সঙ্গে আমাদের পাশাপাশি বাস করতেই হবে। সে ভবিতব্য এড়ানোর কোনো পথ নেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিশেষত সামরিক ও নিরাপত্তা প্রশ্নে আমরা নানাভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়াবহ চিত্র আঁকা হচ্ছে, তাতেও ভারতের সঙ্গে আমাদের নিয়তি জড়িত। এ অবস্থায় ভারত শত্রু না হয়ে যদি বন্ধু হয় তাহলেই আমাদের লাভ। যে রাজনৈতিক দল ‘ভারত আমাদের শত্রু’—এই মন্ত্র জপে ক্ষমতা দখল করবে, তাঁরা চাইলেও ভারতের সঙ্গে মন খুলে হাত মেলাতে পারবে না। ভারত তাঁদের কথায় বিশ্বাসই বা কেন করবে? দলের সমর্থকদেরই বা তাঁরা কী বলে জবাব দেবে? অন্যকথায়, লোহার খাঁচার ভেতর নিজেকে ঢুকিয়ে রেখে রাজনীতি করার ফল খুব ভালো না হওয়ারই কথা।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে সবাই যেভাবে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন, তাতে স্পষ্ট, বিরোধীপক্ষ এটাকে একটি ‘মেক অর ব্রেক’ ইস্যু বলেই ভাবছে। চুক্তির ভালো দিক মন্দ দিক নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছে, সবই চূড়ান্ত দলীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে। যে কথাটা খুব একটা আলোচিত হয়নি তা হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সামরিক ও কৌশলগত দিক। দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদী সন্ত্রাসের উত্থানের পর পাকিস্তান ও ভারত নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্ররা স্পষ্টতই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, এই দুই দেশকে হাতে না রাখলে এই যুদ্ধে তাদের পক্ষে জেতা অসম্ভব। পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের বড় ঘাঁটি, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি। ভিন্ন ভিন্ন শর্তে হলেও এই দুই দেশের সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক মিত্ররা এক ধরনের সামরিক ও কৌশলগত আঁতাত গড়ে তুলেছে। এখন পাকিস্তানের ভেতর যে তালিবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চলছে, তাতে খোশমেজাজে না হলেও পাকিস্তান আমেরিকার সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। অন্যদিকে, ভারত এ অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সামরিক ও কৌশলগত মিত্র ও অংশীদার হয়ে উঠেছে।
ভারত আমেরিকার চোখে কী রকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা একটু খুলে বলি। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ওয়াশিংটন সফর করেন। সে সময় তিনি কংগ্রেসের উভয় কক্ষের এক যৌথসভায় ভাষণ দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য এ ছিল এক অভূতপূর্ব সম্মান। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের বাইরে অন্য খুব কম দেশের নেতা-নেত্রীর ভাগ্যেই এমন সম্মান জুটে থাকে। কিন্তু সম্মানের চেয়েও বড় কথা, এ ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা রণকৌশলে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার স্বীকৃতি। সে সফরকালে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার একটি ছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য মার্কিন আণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তরে আমেরিকার সম্মতি। ১৯৭৪ সালে ভারত আণবিক অস্ত্র অর্জন করে, সে ঘটনায় আমেরিকা মোটেই খুশি হয়নি। সোভিয়েতের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা যে তার নাখোশ হওয়ার অন্যতম কারণ, তা বলাই বাহুল্য। তার অসন্তুষ্টি বোঝাতে ওয়াশিংটন ভারতের ওপর দীর্ঘদিন নানা রকম চাপও বজায় রাখে। কিন্তু ৯/১১ ঘটনার পর থেকে ভারতের ব্যাপারে আমেরিকার মনোভাব বদলে যায়, ভারত হয়ে ওঠে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও অংশীদার। এই অংশীদারিত্ব কতটা ঘনিষ্ঠ, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আণবিক চুক্তি থেকেই তা স্পষ্ট। এখন আমেরিকার চোখে ভারতের আণবিক ক্ষমতা হুমকি নয় বরং তার অর্থাত্ আমেরিকার আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। সে কথার প্রমাণ হিসেবে আমেরিকা কেবল আণবিক প্রযুক্তিই নয়, ভারতকে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র দিতেও সম্মত হয়। এসব অস্ত্রশস্ত্রের অন্যতম হলো, সাবমেরিনে ব্যবহারযোগ্য এজিস প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। চার বছর পর, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বারাক ওবামা গত বছরের নভেম্বরে প্রথম যে বিদেশি সরকারপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়িত করেন তিনি ড. মনমোহন সিং।
সামরিক ও প্রতিরক্ষা বিষয় নিয়ে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন তাঁদের ধারণা, সন্ত্রাস প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান অনেকটা ইসরায়েলের মতো। মিসর বা জর্ডানের সঙ্গে তার যত দহরম-মহরম থাকুক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা কোনো আরব দেশকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। কিন্তু ইসরায়েলের ব্যাপারে তাঁর আস্থা এক শ ভাগ, তা ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন। একইভাবে, দক্ষিণ এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলে পাকিস্তান বা অন্য কোনো ইসলামি দেশকে আমেরিকা পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। এদের কারও কারও সঙ্গে তার সামরিক আঁতাত আছে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক পট বদলে গেলেই সব ঘুঁটি উল্টে যেতে পারে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ইসরায়েলের মতো ভারতও নিজের অস্তিত্বের তাগিদে আমেরিকার সঙ্গে সামরিক ও কৌশলগত আঁতাত বজায় রাখবে, তা সেখানে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন।
ভারত ও আমেরিকার এই কৌশলগত আঁতাত, এটা একটা বাস্তবতা, তা আমরা ভালো চোখে দেখি বা না দেখি। যে ইসলামি সন্ত্রাসের কথা মাথায় রেখে এই সামরিক ও কৌশলগত আঁতাত গড়ে উঠছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। আমাদের দেশে ইসলামি মৌলবাদের হুমকি যে অলীক বা বানানো কল্পকাহিনী নয়, গত পাঁচ-সাত বছর তা আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে। ধর্মীয় চূড়ান্তবাদীদের হুমকি এখন অবশ্য কমেছে, বিশেষত রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হওয়ায়, কিন্তু একদম উবে যায়নি। বাংলাদেশে ইসলামী সন্ত্রাসের জমি তো তৈরিই, চোখ-কান খোলা না রাখলে সেখানে ফসল বোনা অসম্ভব ব্যাপার নয়। এ কথা ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই তেমন সম্ভাবনা ঠেকাতে চায়। সে উদ্দেশ্যে তারা বাংলাদশকেও তাদের সামরিক ও কৌশলগত আঁতাতের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। এ নিয়ে কাজ চলছে, তার নানা সাক্ষ্য-প্রমাণও আমরা পাচ্ছি। যেমন—গত বছর আসামে ভারত ও বাংলাদেশ সামরিকবাহিনী যৌথভাবে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে (বিস্তারিত দেখুন, ইন্ডিয়া ডিফেন্স, ১৪ জানুয়ারি ২০০৯)। বিশিষ্ট ভারতীয় বিশ্লেষক ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গুলি সে কথা উল্লেখ করে ইঙ্গিত করেছেন, ক্ষমতার হাত বদল হওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সন্ত্রাস দমন প্রশ্নে সহযোগিতার সম্ভাবনা প্রশস্ত হয়েছে। এদিকে, মাত্র গত সপ্তাহেই প্রথম আলো খবর দিয়েছে, জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের র্যাব ও পুলিশকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্য কথায়, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের এই বহুরৈখিক চরিত্রটি কোনো পক্ষ থেকেই স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ভারত তো নয়ই, বাংলাদেশও এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় এসব প্রশ্ন হয়তো খোলামেলা আলোচিত হবে না, তেমন আশা করাও অনুচিত। কিন্তু দেশের মানুষকে মোদ্দা ব্যাপারটা বোঝানো দরকার। ভারতকে নিয়ে আমাদের মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া দরকার। বিরোধী পক্ষকেও সে কথা বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। দলীয় কলাম লেখক দিয়ে নয়, খোদ সরকারের নেতা-নেত্রীদেরই সে কাজটি করতে হবে।
ওবামা নেকড়ের গুহায় ঢুকে বহাল তবিয়তে বেরিয়ে এসেছেন। তাতে আখেরে তাঁর দলেরই লাভ হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও যদি সেই একই কাজ করেন, তাহলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারার কাজটি করা সম্ভব হবে। কীভাবে সে গুহায় ঢুকবেন, তাঁকে সে বুদ্ধি দেওয়া আমার কাজ নয়। সে কথা তাঁর নিজেরই ঢের ভালো জানা আছে।
নিউইয়র্ক, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.