মেধা-বিকাশ-এবার বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

এই প্রথমবারের মতো সারা দেশে স্কুলের ছাত্রদের জন্য বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন করল বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি। পৃথিবীর এক সহস্রাংশ ভূখণ্ড বাংলাদেশ ঠাঁই দিচ্ছে বিশ্বের দুই দশমিক চার শতাংশ অধিবাসীকে। একমাত্র অতিরিক্ত সম্পদ বলতে জনসংখ্যা, যা উন্নয়নের অভাবে জনসম্পদে রূপান্তরিত হয়ে দেশের অগ্রগতির চাকায় ত্বরণ জোগাড় করতে পারছে না।


বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে দেশকে বের করার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের ভূখণ্ড যখন পরাধীন ছিল, বিজ্ঞানের ভান্ডারকে তখন আমরাই শ্রেষ্ঠ অর্জন দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলাম। এরপর সময়ের সঙ্গে আমাদের অর্জন আর অবদান ক্রমশই মলিন হয়ে আসছে। উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের সমপর্যায়ে থাকা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কোরিয়া যখন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনো এগুলো দেখে আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। একমাত্র উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নই হলো অগ্রগতির চাবিকাঠি।
বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক শমশের আলী এবং সেক্রেটারি অধ্যাপক নাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে সম্প্রতি অনেকগুলো উদ্যোগের সূচনা করা হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞানের তরুণ ছাত্র বা স্নাতকেরা যাতে বিজ্ঞানের প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে পারে, তার জন্য নোবেল বিজয়ীদের লিন্ডাও কনফারেন্সে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করছে। এ ছাড়া জাপান আয়োজিত অনুরূপ কনফারেন্সে অংশগ্রহণও নিশ্চিত করছে। দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার মানোন্নয়নে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অংশগ্রহণে কর্মশালা আয়োজন করেছে, নবীন গবেষকদের উত্সাহিত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি নবীন বিজ্ঞানীদের কনফারেন্সেরও আয়োজন করেছে। এরই হাত ধরে আয়োজিত হলো বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সিদ্ধান্ত হলো, সারা দেশে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিভাগীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজিত হবে। এবার দেশের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জানুয়ারি আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বিভাগ থেকে গড়ে শতকরা ১০ জনকে জাতীয় অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এবার যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হলো, তা হলো অধ্যাপক ফারুকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে চুয়েটে, অধ্যাপক খসরু মিয়ার নেতৃত্বে ডুয়েটে, অধ্যাপক মাহবুব মজুমদারের নেতৃত্বে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যাপক মাহবুব আলমের নেতৃত্বে কুয়েটে, অধ্যাপক আশরাফুল আলমের নেতৃত্বে রুয়েটে, অধ্যাপক মোস্তফা জামানের নেতৃত্বে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যাপক আর আই শরীফের নেতৃত্বে সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক নুরুল আবছারের নেতৃত্বে ইউএসটিসিতে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো অধ্যাপক কাজী আবদুল ফাত্তাহ, অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমাদ, অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, অধ্যাপক আলী আসগর, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ এবং অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বিজ্ঞানের প্রতি ছাত্রদের উত্সাহদানের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন।
এই ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয়ী প্রায় ৪০০ ছাত্রকে নিয়ে ২২ জানুয়ারি (মাসের চতুর্থ শুক্রবার) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শীতের সাতসকালে বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ইজতেমার জন্য বাস, ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তিতে সন্দেহ থাকায় অনেকেই এক-দুই দিন আগেই এসেছেন। তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা ও বিজ্ঞানে উত্সাহিত করতে অভিভাবকদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্য আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাই। যে অভিভাবকেরা সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য এ কষ্ট হাসিমুখে শিকার করছেন, এক দিন তাঁদের ছেলেমেয়েরা যে এই দুঃখী দেশমাতৃকার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে, তাতে সন্দেহ নেই।
সকাল সাতটা থেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যে আনন্দমুখর পরিবেশ, তাতে শীতও হার মেনেছে। অডিটোরিয়ামের সামনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ স ম শফিউল্লাহ এবং বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক এম শমশের আলী বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। লাল টি-শার্ট পরা অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ানো ৪০০ ছাত্রের দৃশ্য ছিল অভূতপূর্ব। সকাল ১০টার দিকে পতাকাসজ্জিত রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ইএমই ভবনের ১০টি কক্ষে তারা পরীক্ষা দিতে চায়। এবার অলিম্পিয়াডে যথেষ্ট সৃজনশীল প্রশ্ন করে ছাত্রদের বিজ্ঞানের ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে পরীক্ষা করা হয়েছে।
বিভিন্ন বিষয়ে যশস্বী অধ্যাপকদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জুনিয়র গ্রুপে (অনূর্ধ্ব অষ্টম শ্রেণী) ৬০ নম্বরে ৪৭ পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র রাকিব আহমেদ। পক্ষান্তরে সেকেন্ডারি গ্রুপে ৬০ নম্বরের মধ্যে ৩৮ পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে খুলনা পাবলিক কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আবু শাকিল আহমেদ, চিটাগাং গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণীর বৃষ্টি শিকদার, একে উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর মো. শরীফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শোভন বিশ্বাস। দুই ঘণ্টার এই পরীক্ষায় ছাত্রদের ৬০টি করে প্রশ্নের উত্তর করতে হয়।
পরীক্ষা শেষে মধ্যাহ্নভোজের পর শুরু হয় উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব। সিলেট থেকে শীতের কুয়াশা ভেদ করে জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও কলাম লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল অংশ নেন। তরুণ-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের নানা অনুসন্ধিত্সার চাহিদা মেটান একাডেমির ফেলো অধ্যাপক কাজী আবদুল ফাত্তাহ, ফেলো মেসবাহ উদ্দিন আহমাদ, ফেলো অধ্যাপক আলী আসগর। ছাত্রদের প্রশ্ন করার সাহস দেখে মনে হয়, শুধু অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই তারা নিজেরাই অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এবং বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করে সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বুয়েটের সিএসই বিভাগের ড. মো. হুমায়ুন কবীর। প্রায় ৫০ জন ছাত্রকে বিজয়সূচক মেডেল দেওয়া হয় তুমুল করতালির মাধ্যমে। দেশের প্রায় ১০০টি স্কুল থেকে আসা ৪০০ প্রতিযোগী নিঃসন্দেহে অনেক উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বাড়িতে ফিরেছে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক শফিউল্লাহ ছাত্রদের বিজ্ঞানচর্চায় উত্সাহিত করেন। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক শমশের আলী অভিভাবকদের কাছে আবেদন রাখেন, যাতে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়তে উত্সাহিত করেন। বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো অধ্যাপক আলী আসগর বলেন, রসায়নবিদ হামেফ্র ডেভিডকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কী। তিনি উত্তরে সেফটি ল্যাম্পের কথা বলেননি, বলেছিলেন ফ্যারাডের নাম। তিনি মনে করেন, আমাদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ এই মেধাবী ছাত্রদের বের করে নিয়ে আসা। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম এবং অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমাদও ছাত্রদের বিজ্ঞানের প্রতি উত্সাহিত করতে বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য অধ্যাপক আমিনুল হক, অধ্যাপক ফিরোজ আলম খান, অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম, অধ্যাপক ওয়াহাব খান, ড. মো. হুমায়ুন কবীর, ড. মো. সোহেল রহমান, অধ্যাপক মো. আবদুল হাকিমকে নিয়ে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।
আশা করি, আগামী দিনেও এ রকম উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অলিম্পিয়াড কর্মসূচি নিয়মত অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের তরুণ-কিশোরেরা বিজ্ঞান নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, তার বাস্তবায়ন ঘটাবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের দেশ বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পরশে অগ্রগতির পথে ধাবিত হবে। তখন আর আমাদের দেশের সেতু নির্মাণে বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে না, সার কারখানাও আমাদেরই বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা তৈরি করতে পারবেন। আমাদের মাটির নিচের গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরও ডাকতে হবে না এবং এই মূল্যবান সম্পদের অপচয়ও হবে না। আমাদের উপকূলে সাগরের নিচে কী কী সম্পদ আছে, তা নিরূপণের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হবে না, পকেটে রাখা মোবাইল ফোনগুলো আর বিদেশি কোম্পানির হবে না, ডিজিটাল বাংলাদেশ রচনায় যাবতীয় বড় বড় কাজ যখন বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে করার প্রয়োজন থাকবে না, তখনই আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হব। অর্থনীতি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান—সবই আমরা অন্য উন্নত দেশের মতো নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এমন দেশের অপেক্ষায় আমরা আছি, যা আমাদের অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী তরুণ-কিশোরেরা অদূরভবিষ্যতে রচনা করবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট। ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী।

No comments

Powered by Blogger.