সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মাইলফলক অর্জন-হাইকোর্টের রায় বহাল

পঞ্চম সংশোধনী-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে সমুন্নত হলো। এটি আইনের শাসনের জন্য একটি বিশাল বিজয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তাঁর নিজের ওপর চেপে বসে থাকা জগদ্দল পাথরের অবসান ঘটালেন। জাতীয় সংসদের আলোচনায় ২ ফেব্রুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত


সেনগুপ্ত যথার্থই বিচার বিভাগকে সংসদের পক্ষ থেকে তার যথাযথ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্য অভিবাদন জানান। আমরাও মনে করি, বিচার বিভাগ তার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে নিজের সৃষ্ট কালিমার বর্ণময় অপনোদন ঘটাল। অভিনন্দন তাদের প্রাপ্য।
আমরা অভিনন্দন জানাই এর আগে প্রদান করা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়কে। সেই মামলার রায় কেবল রেওয়াজ অনুসরণ করে কেবল ‘মুন’ সিনেমা হলকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণাকারী ১৯৭৭ সালের সামরিক প্রবিধানের বৈধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সংবিধান রক্ষার অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট। এ সত্য বাস্তবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কাকতালীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন করার রেশ মিলিয়ে না যেতেই সম্পূর্ণ পৃথক মামলা, অথচ ইতিহাসের একই ক্ষত সারানোর ইস্যু সুপ্রিম কোর্টের সামনে এল। অতীতে কখনোই পঞ্চম সংশোধনী বা সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধান স্থগিত বা তাকে ফরমানের অধীন করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। কিন্তু অন্তত পাঁচটি মামলায় বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক ফরমান দিয়ে তৈরি আইনের বৈধতা যাচাই হয়েছে এবং আদালত সেসব ফরমানকে আইনের মর্যাদা দিয়েছেন।
বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ১৯৭৫ সালের সামরিক আইনকে ‘কেবলই সাংবিধানিক বিচ্যুতি’ এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অষ্টম সংশোধনীর মামলায় কেউ চ্যালেঞ্জ না করায় ১৯৭৫ সাল থেকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস জনগণের নীরব সম্মতিতে বৈধ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এরশাদের আমলের সামরিক ফরমানও প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল উচ্চ আদালতে। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের পক্ষে লিভ আবেদনকারীদের আইনজীবীরা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে বড় করে তুলে ধরেন। তাঁরা যুক্তি দেন, আপিল বিভাগ এরই মধ্যে পঞ্চম সংশোধনী তথা সামরিক ফরমানের বৈধতা নিশ্চিত করেছেন। তাই এখন আর নতুন করে হাইকোর্ট তা ওল্টাতে পারেন না। আপিল বিভাগ এ ধরনের যুক্তি অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় নাকচ করেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো, সামরিক আইন ও ফরমান চিরকালের জন্য অবৈধ থাকবে। সংসদ বা আদালত একে বৈধ করতে পারবে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এক-এগারোর পরে সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো দুঃসাহসের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এই রায় একটি প্রতিসাম্য হিসেবে কাজ করেছিল।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কার্যত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সেই নন্দিত আসমা জিলানির রায়টি ধারণ করলেন। ১৯৭২ সালের ওই রায়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলকে প্রথম অসাংবিধানিক ও তাঁকে ক্ষমতা জবরদখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমাদের আলোচ্য রায়েও মোশতাক-সায়েম-জিয়া প্রত্যেকেই ক্ষমতা জবরদখলকারী হিসেবে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত হলেন।
এখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় চ্যালেঞ্জ হলো, তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সব মহলের উপযুক্ত শিক্ষা নেওয়া।

No comments

Powered by Blogger.