খোলা হাওয়া-ভাষার বিকাশ: কঠিনেরেই ভালোবাসতে হবে by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগটা এমনই যে, ফেব্রুয়ারি মাসের শুধু একটি দিন—২১ ফেব্রুয়ারি নয়, এখন মাসজুড়েই থাকে এর প্রকাশ। ফেব্রুয়ারি এখন ভাষার মাস, বইমেলার মাস। একুশে এখন শুধু শোকে মোড়া একটি দিন নয়, একুশে এখন একটি কালজয়ী চেতনার নাম, যাকে উদ্যাপন করতে হয়, যা থেকে সারা বছর শক্তি সংগ্রহ করতে হয়।


ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগ স্বাধীনতার পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার যেমন প্রেরণা দিয়েছে, স্বাধীনতার পর জাতি গঠনে, দেশ-বিকাশে তেমনি শক্তি জুগিয়েছে। একাত্তরে যে দেশটি আত্মপ্রকাশ করেছিল এক ভয়ানক প্রতিকূল বিশ্বে, প্রায় চার দশকের পথচলায় সে দেশটি এখন সংহত, আত্মপ্রত্যয়ী। আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ দেশটিকে ডুবতে দেননি; দেশটিকে পানির ওপর ভাসিয়ে রাখার জন্য তাঁরা কঠিন সংগ্রাম করছেন। সেই সংগ্রামে তাঁদের প্রতিপক্ষ যে শুধু দারিদ্র্য, অপুষ্টি, বৈরী আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা বিশ্বমন্দার মতো অপ্রতিরোধ্য শক্তি, তা-ই নয়; সেই তালিকায় আরও আছেন স্বার্থোন্মত্ত বুর্জোয়া, আদর্শহীন রাজনীতিবিদ, উচ্চাভিলাষী সমরবিদ, ধর্মান্ধ মৌলবাদী, বিবেকহীন আমলা ও বুদ্ধিজীবী। তাঁরা সবাই নিজের স্বার্থে এ দেশকে চোবানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা দেশের মঙ্গল কখনো চান না, চান নিজের উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন। তাঁরা দেশের মিত্র নন, ভাষারও মিত্র নন। তাঁরা যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাতে সুস্পষ্টতা নেই—যেহেতু তাঁদের ভাবনাতে স্পষ্টতা নেই, সততা নেই। তাঁদের হাতে ভাষা মার খায়। ভাষার ঘরের শত্রুদের সঙ্গে এবার যোগ দিয়েছে বিশ্বায়নের দুই দানবসন্তান—পণ্যসংস্কৃতি ও মিডিয়াসংস্কৃতি। এরাও আঘাত হানছে বাংলা ভাষার ওপর। এই আঘাত সামলে বাংলা ভাষাকে বিকশিত হতে হবে। দেশের অর্থনীতিবিদেরা শুধু নন, বিদেশের এমনকি বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের অর্থনীতির ঠাকুরেরাও বলেন, বাংলাদেশের সামনে সুদিন আসছে। পিঠে জনসংখ্যার এক বিশাল বোঝা নিয়েও বাংলাদেশ ওপরে ওঠার মইতে পা রেখেছে। বাংলাদেশকে আরও দৃঢ়চেতা হতে হবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে এবং ওপরে ওঠার পরিশ্রমটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে করতে হবে। এই কৃতসংকল্প জাতির ভাষাকে তাই হতে হবে তার সংকল্পের, সততার এবং তার স্বপ্নের সমান্তরাল। সেই ভাষাকে আরও স্পষ্ট ও বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে হবে এই সংকল্প, সত্য ও স্বপ্নকে।
দেশ তৈরি হচ্ছে, জাতি তৈরি হচ্ছে, কিন্তু ভাষা কি তৈরি হচ্ছে এই নতুন যুগের জন্য, যে যুগটি হবে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বিজয়ের, যে যুগটি বাংলাদেশকে পৌঁছে দেবে সম্ভাবনার সদর রাস্তায়—১০০ রকমের প্রতিকূলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলের বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও? আমার ভয়, ভাষার অঞ্চলে জাগরণের লক্ষণ এখনো অনুপস্থিত। ভাষা পিছলে পড়ছে কিছু সহজ অপভাষার ফাঁদে, ভাষার প্রকাশসম্ভাবনা খর্ব হচ্ছে পণ্য ও মিডিয়াসংস্কৃতির কাছে আমাদের আত্মসমর্পণের কারণে।
আমার ভয়ের উত্স বাস্তব অভিজ্ঞতা। সাড়ে তিন দশক ধরে আমি শিক্ষকতা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং খুব কাছে থেকে যুবসমাজের পরিবর্তনগুলো দেখেছি। আমি তাদের আবেগ, ক্রোধ, হতাশা ও আনন্দ বুঝতে পারি, তাদের জন্য সহমর্মিতা অনুভব করি। সমাজ গতিশীল হচ্ছে, নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক নতুন সম্ভাবনা ও সমস্যাও সৃষ্টি করছে; সেগুলো আমি বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার বিস্তার ঘটলেও মান কমছে; জ্ঞানমুখী না হয়ে সনদমুখী হচ্ছে শিক্ষা। পড়ার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, দৃশ্যমাধ্যমের প্রতি আগ্রহ ও আনুগত্য এখন ব্যাপক। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়, তা হচ্ছে, ভাষার প্রতি এক বিশাল অনীহা। ভাষা যে শুধু একটি সহজ অর্জনের বিষয় নয়, একে যে পরিমার্জন করতে হয়, এর উত্কর্ষের পথগুলো নিরন্তর তৈরি করতে হয় এবং এর প্রকাশের শক্তি ও সম্ভাবনাকে বাড়াতে হয়, এ বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তার অভাব আমি লক্ষ করি। বাংলা ভাষার একটি বর্ণমালা আছে, এর ধ্বনিগুলো উচ্চারণের কিছু সূত্র আছে এবং এর একটি সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার আছে, কিন্তু বাস্তব ব্যবহারে এসব সত্যকে ক্রমাগত অবহেলিত হতে দেখি। এখন তো দেখতে পাচ্ছি, কেউ কেউ এ রকমও বলেন, মানভাষা হলো প্রতিক্রিয়াশীলতার ভাষা; যিনি মানভাষার কথা বলেন, তিনি প্রতিক্রিয়াশীল। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মিডিয়ার ভাষাটাই সবার ভাষা। একজন আমাকে জানিয়েছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীলেরা ‘আপামর ভাষাকে নেগলেক্ট করেন’। ‘আপামর’ কথাটি আমি ব্যবহার করি না—এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ—আমি সমাজের উচ্চ-নিচ (পামর), আশরাফ-আতরাফ বিভাজনে বিশ্বাস করি না, সেজন্য। আমি কথ্য ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করি, কিন্তু প্রমিত ভাষার গুরুত্বের ক্ষেত্রে আস্থাবান। আমি বিশ্বাস করি, সব ভাষার একটি প্রমিত রূপ আছে, যা ওই ভাষার শ্রেষ্ঠ চিন্তা ও কল্পনাগুলো প্রকাশ করতে পারে। ওই ভাষাভাষীর বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য ও নান্দনিকতার অভিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগুলো অনেক গভীরতায় বাঙ্ময় করতে পারে। কিছুদিন থেকে একটা বিতর্ক চলতে দেখছি, যে বিতর্কটি মানভাষা বনাম মিডিয়াভাষা নিয়ে, যে বিতর্কে তরুণের ভাষার বিপরীতে প্রবীণের ভাষাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটি একটি অহেতুক বিতর্ক। কিন্তু একে আমলে আনতে হয়, যেহেতু অনেক তরুণের এ রকম একটি ধারণা জন্মেছে যে মিডিয়ার ভাষা—আরও স্পষ্ট করে বললে, মিডিয়ার, নাটকের ও বিজ্ঞাপনের ভাষাই হচ্ছে এ সময়ের, তরুণদের প্রমিত ভাষা। এই ভাষাই ‘আপামর’ জনসাধারণের, এটিই মায়ের ভাষা, আটপৌরে ভাষা। কেউ কেউ যুক্তি দেখান, আমাদের মুখের ভাষাই তো হওয়া উচিত মানভাষা।
এই বিতর্ক যখন শুরু হয়েছে, এটি নিশ্চয় অনেক দিন চলবে। কিন্তু এর এক পক্ষে যখন নিজেকে দেখতে পাই, তখন এই ‘বিপক্ষের’ অবস্থানটা পরিষ্কার করে নেওয়াই সংগত। আমি নিশ্চিত, অনেকেই মিডিয়া-নাটকের ভাষায় আস্থা স্থাপন করেন, এফএম রেডিওর ভাষাকে ‘স্মার্ট’ ভেবে সেটি ব্যবহার করেন এবং এ রকম ভাষাকে তরুণের সহজাত ভাষা হিসেবে দেখেন। কিন্তু শুধু এই জায়গাটিতে যদি তাঁরা আটকে থাকেন, তাহলে বাংলা ভাষার অনেক সম্পদশালী অঞ্চল, এর প্রকৃত শক্তি ও সৌন্দর্য তাদের অগোচরেই রয়ে যাবে। এটি কাম্য নয়।

২.
শুরুতেই একটি বিষয় নিশ্চিত করা উচিত, যাঁরা মানভাষার বিরোধিতা করেন, তাঁরা বলেন, এটি নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়, এটি নির্মিত ভাষা। কথাটি খুবই খাঁটি। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার যে প্রমিত রূপ, তা বহুদিন ধরে অল্প অল্প করে নির্মিত হয়ে আসছে; জারিত, নিকষিত ও পরিশীলিত হয়ে আসছে। এই ভাষা-নির্মাণ ভাষার গভীরতা বাড়ানোর জ্ঞান প্রকাশ ও ধারণে এর পারঙ্গমতা বৃদ্ধির একটি সমন্বিত সর্বজনীন প্রকাশ। ফলে এটি কোনো বিশেষ অঞ্চলে নয়, সময়ান্তরে এর রূপ পাল্টায়, কিন্তু মূল বা সারবস্তু, এর আন্তরিক অবস্থান এবং এর সংকলিত জ্ঞানসামগ্রী পাল্টায় না; বরং আরও গভীরতা ও দার্ঢ্য পায়। প্রমিত ভাষার সঙ্গে কথ্য ভাষার অথবা আঞ্চলিক ভাষার বিরোধ নেই। এরা একে অপর থেকে গ্রহণ করে, সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু কথ্য ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞান বা দর্শনচর্চার ভাষা হতে সক্ষম হয় না, যেহেতু কথ্য ভাষার অঞ্চলটি সীমিত। বস্তুত, এক অঞ্চলের কথ্য ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষ বলতে বা বুঝতেও পুরোপুরি সক্ষম হয় না। আঞ্চলিক ভাষাও তাই। এগুলোর শক্তি তাদের প্রাত্যহিকতায়, তাদের ভৌগোলিকতায়। বাংলা ভাষাকে যখন আমরা উদ্যাপন করি, তখন আঞ্চলিক ভাষা অথবা বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ভাষাকেও আমরা উদ্যাপন করি, যেহেতু এগুলোয় জীবনের উত্তাপ থাকে। যেসব সাহিত্যে মুখের ভাষাটি মুখেই বলা হয়—যেমন, নাটকে অথবা গল্প-উপন্যাসের কথোপকথন অংশে—সেসব সাহিত্যে কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার স্বাভাবিক এবং এর একটি দীর্ঘ ঐতিহ্যও রয়েছে। কিন্তু মিডিয়া-ভাষা? এটিও কি নির্মিত নয়? মিডিয়া-নাটক ও বিজ্ঞাপনের যে ভাষা, তা বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের? এ ভাষা প্রসারে মিডিয়া কেন এত আগ্রহী? এই ভাষায় কি বৈচিত্র্য সন্ধানের আগ্রহ আছে, নাকি আছে সামান্যীকরণের প্রবণতা? আমাকে অনেকে বলেন, এই ভাষা এখন সবাই বলতে শুরু করেছে। আমার তাতে আপত্তি নেই, যদি সেটি বাংলা হতো। কিন্তু একটি বাক্যে যদি চারটি ইংরেজি শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়, যেগুলো টেবিল-চেয়ারের মতো নির্বিকল্প নয়, যেগুলোর সহজ চালু ও সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ আছে। যেমন—‘বাট’ ‘লাইক’ ‘সো’। তাহলে আমার একটা আপত্তি থেকেই যাবে।

৩.
কয়েক তরুণ আমাকে ভাষা নিয়ে বাহাস করার আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরা মিডিয়া-ভাষার সমর্থক এবং প্রমিত ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে ভাবেন। তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন এই মিডিয়া-ভাষা অপছন্দ করি। একজন বললেন, তাঁদের ভাষাটা আটপৌরে। এটিই তো মায়ের ভাষা। এই ভাষা সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত। একে কেন আমি মূল্য দিই না ইত্যাদি।
আমি তাঁদের কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। এর একটি ছিল, পৃথিবীর আর কোনো ভাষাভাষী (এই উপমহাদেশ ছাড়া, যার উপনিবেশি ইতিহাসটি দীর্ঘ ও গ্লানিময়) তার নিজের ভাষায় অন্য ভাষার অকারণ অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ব্যবহার করে এবং গঠিত হয়? কোনো ইংরেজ কি বাংলা শব্দ ঢোকায় তার ভাষায়? ‘বাট’-এর জায়গায় ‘কিন্তু’ লাগায়? ‘সো’ না বলে ‘কাজেই’ বলে? কোনো চীনা করে? আমি তাঁদের বললাম, চীনের রেডিও পৃথিবীর সব জায়গা থেকেই প্রায় শোনা যায়। একদিন ১৫ মিনিট কোনো চীনা অনুষ্ঠান শুনে আমাকে যেন তাঁরা জানান, কতগুলো ইংরেজি শব্দ সেখানে ব্যবহূত হয়েছে। আমাদের এফএম রেডিওতে বাংলাকে বিকৃত করে উচ্চারণ করা হয় এবং এটি বেশ গর্বের সঙ্গেই করা হয়; অথচ নেপালের এফএম রেডিওগুলো শুদ্ধ নেপালিতে অনুষ্ঠান করে। তাদের শ্রোতারাও তরুণ; তারা আমাদের শ্রোতাদের চেয়ে কম স্মার্ট নয়।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল এক তরুণকে, যে বলছিল প্রমিত ভাষা একটা চাপিয়ে দেওয়া ভাষা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পৃথিবীর কোন জাতি তার সাহিত্য, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চিন্তাগুলো মিডিয়া বা কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষায় লিখে রেখেছে। বাংলা ভাষার রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের কথা ছেড়েই দিলাম, যেহেতু তাঁরা মিডিয়া-সংস্কৃতির আগের মানুষ, একেবারে হাল সময়ের শ্রেষ্ঠ কয়টি কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ লেখা হয়েছে সম্পূর্ণ কথ্য বা মিডিয়া-ভাষায়?
আর তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল তাদের, যারা মিডিয়া-নাটকের ভাষাকে স্বাভাবিক, আটপৌরে আর মায়ের ভাষা দাবি করে এর পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছিল। তারা যেহেতু মায়ের উপমা দিয়েছিল, আমি আমাদের মায়েদের আটপৌরে জীবন থেকেই শুরু করেছিলাম। একজন মা, যিনি সারা দিন ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সাধারণ একটা শাড়ি পারেন, হয়তো আঁচলে হলুদের দাগ লেগে থাকে ইত্যাদি, তিনিই কি সন্ধ্যায় একটা পোশাকি অনুষ্ঠানে, যেমন কোনো বিয়েতে যাওয়ার সময় একটুখানি সাজেন না, প্রসাধন করেন না, পোশাক পাল্টান না—অন্য কথায় একটুখানি প্রমিত বা পোশাকি রূপ নেন না? তাহলে ভাষার ক্ষেত্রে আপত্তিটা কোথায়?

৪.
পণ্য আর মিডিয়াসংস্কৃতি বাংলা ভাষাকে যেভাবে চেপে ধরেছে, তাতে ফেব্রুয়ারিজুড়ে আমরা যত হইচই করি না কেন, এই ভাষা পঙ্গু হতে থাকবে। টিভিতে ‘টক শো’গুলো শুনুন—বক্তারা প্রতি তিন শব্দে একটি ইংরেজি বলবেন। সেদিন একজনকে বলতে শুনলাম, বঙ্গবন্ধু মার্ডার ট্রায়ালের যে ভার্ডিক্ট আমরা পেলাম, তাতে রুল অব জাস্টিস উইন করল। এর চেয়ে একটু কষ্ট করে ইংরেজিতে বলে ফেললেই তো হতো, তিন-চারটি হতভাগা বাংলা শব্দ অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচত। ইংরেজিটা আমরা শিখব, নিশ্চয়ই শিখব; কিন্তু খণ্ড খণ্ড শিখে সেই খণ্ডগুলোর আঘাতে বাংলার বারোটা বাজাব, তা তো উচিত নয়।
আর উচ্চারণ! কথ্য-মিডিয়া-আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে উচ্চারণে আমরা এনেছি বৈপ্লবিক অরাজকতা। বাংলায় যে চ-ছ-জ-ঝ এই চারটি আলাদা বর্ণ আছে, এখন সেটি প্রায় বোঝাই যায় না। এখন ‘আসার মাসে, স্কুলে আসার পথে, আসার খেতে খেতে, পথ চলতে গিয়ে কেউ আসার খায়’। কিছুদিন পর বর্ণমালার বোঝা এমনিতেই কমে যাবে। ব ড় ঢ় হবে শুধুই র, ইত্যাদি। তখন আমার দুখিনী বর্ণমালা বোঝা ফেলে সুখিনী হবে।
আর উর্দু, হিন্দি বলতে পারলে তো আমরা লেপ্টে যাই। লাহোরে পা দিলেই উর্দু, দিল্লিতে পা দিলেই হিন্দি। নিজের ভাষা নিয়ে এত হীনম্মন্যতা আমি কোথাও দেখিনি।
পণ্যসংস্কৃতি তার প্রসারের জন্য এই হীনম্মন্যতাটুকু চায়; মিডিয়াসংস্কৃতি সহজ ও নিরলস বিস্তারের জন্য নির্ভর করে আমাদের হীনম্মন্যতার ওপর। এই ফেব্রুয়ারিতে ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগ দেখানো শুরু করার আগে এই হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার একটি শপথ নিলে কেমন হয়?
[এই লেখার বিষয়ে আপনাদের মতামত আমরা ছাপতে আগ্রহী।—বিভাগীয় সম্পাদক]
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.