ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকারদানে আইন হতে পারে-হরতাল নিষিদ্ধের দাবি

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) হরতাল নিষিদ্ধ করতে আইন করার যে দাবি জানিয়েছে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। যদিও হরতাল এমনই এক মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, যা আক্ষরিক অর্থে নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।


দেশের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবসায়ী নেতারা স্বাভাবিকই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা ধারাবাহিকভাবে হরতালবিরোধী একটি অবস্থান বজায় রাখছেন। এবারও একটি সভায় এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার পর এ সংগঠনের সভাপতি হরতাল বন্ধ করতে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।
আমরা আশা করি, হরতাল নিষিদ্ধ নয়, হরতাল নিয়ন্ত্রণে এবং সহিংস হরতালজনিত জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও তা প্রতিকারের পথ সুগম করে আইন হওয়া দরকার। সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হলে তার জন্য দেশে আইন রয়েছে, কিন্তু তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। ভারতের উচ্চ আদালত মধ্য নব্বইয়ের দশকে সহিংস হরতাল ও শান্তিপূর্ণ হরতালের মধ্যে পার্থক্য করতে রাজি হননি। তাঁরা বাস্তব যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, শান্তিপূর্ণ হরতাল ও বনেধর নামে যেভাবে কর্মসূচি চলে, তাতে জনজীবনে জোরজবরদস্তি ঘটে। এ রায়ের পর বাংলাদেশের উচ্চ আদালতেও হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয় এবং আদালত হরতালের পক্ষে থেকে বলেন, সহিংস হরতাল করা যাবে না। এ রায় কার্যত উপেক্ষিত হয়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটিয়ে ডাকা হরতাল কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সে মর্মে একটি রুল জারি করেছেন।
সরকারি দল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশকে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি দমনে খুব বেশি অপব্যবহার করে থাকে। বিচার বিভাগের কাছ থেকেও প্রতিকার পেতে বিরোধী দলকে বেগ পেতে হয়। সুতরাং, হরতালের প্রকোপ কমাতে আগে বিরোধী দলের প্রতি সরকারি দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাট পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় হরতাল নিয়ন্ত্রণের আইন করেও তার অপব্যবহার ঘটতে পারে।
বিরোধী দল হরতালের পাশাপাশি প্রতিবাদের নতুন কর্মসূচি অনুশীলন শুরু করতে পারে। শ্রীলঙ্কায় নির্দিষ্ট সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা টিন পিটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে থাকেন। এফবিসিসিআইয়ের আহ্বানে একবার ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছিল। হরতালের মতো চোখা কর্মসূচির বিকল্প হয়তো শুরুতেই পাওয়া যাবে না। তবে দেশ ও দশের ভালো চাইলে প্রথাগত কর্মসূচিগুলোর বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজতেই হবে।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ হরতালে যারা ভাঙচুর, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়, তাদের শনাক্ত ও প্রতিকার প্রদানে যথার্থই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে নির্দেশ দিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ও গণমাধ্যমের ব্যক্তিত্ব সমন্বয়ে দুটি কমিটি করেছিলেন। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের পর সহিংসতায় পাঁচজনের মৃত্যুসহ বহু সম্পদের হানি ঘটেছে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল পরস্পরকে দোষারোপ করে ‘দায়মুক্তি’ নিচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে তাদের যেন মানবিক দায়টুকু নেই। নির্বাচিত সরকার ও বিরোধী দলের তকমা এঁটে এবং হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার বলেই তারা পার পেতে পারে না। সরকার ও বিরোধী দলের এই মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। তাই হরতালের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আইন হোক।

No comments

Powered by Blogger.