বৌদ্ধ ধর্মে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি by জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া

ভ্রাতৃত্ববোধ কথাটার ব্যাপকতার চেয়ে গভীরতা খুব বেশি। কোনো মানুষকে সহজে আপন বা নিজ ভাইয়ের মতো করে নেওয়া সহজ নয়। আবার মৌখিকভাবে 'ভাই' সম্বোধন করে নৈকট্য লাভ করা এক জিনিস, অন্যদিকে কাউকে আন্তরিকভাবে ভাই হিসেবে গ্রহণ করা অন্য জিনিস।


এই ভ্রাতৃত্ববোধটা মৌখিক প্রকাশের চেয়ে হৃদ্ধিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভ্রাতৃত্ববোধ ধারণাটি নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রসার করা যত সহজ, অন্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে প্রসারিত করা তত সহজ নয়। তাই এই ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মানসিক গঠন, অনুশীলন ও শুদ্ধ চর্চার প্রয়োজন। অন্যদিকে ধর্মীয় সম্প্রীতি কথাটার মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার দিকটা প্রধান। এতে অন্যের ধর্মকে অশ্রদ্ধা বা কটূক্তি না করা স্বভাবতই এসে যায়। যেখানে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিদ্যমান থাকে। ভ্রাতৃত্ববোধের আওতা সীমিত হলেও ধর্মীয় সম্প্রীতির আওতা অনেক বড় হতে পারে। ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি এ দুটো বিষয়ের ধারণ, লালন ও অনুশীলন পুরোপুরি নির্ভর করে কতগুলো মৌলিক মূল্যবোধের ওপর। এসব মূল্যবোধ ধর্মীয় বা সামাজিক যাই হোক না কেন- আজন্ম লালিত হয়ে থাকে। যেমন কোনো ব্যক্তি হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা অথবা ভদ্রতা, নম্রতা পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা বা পরিবেশের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল, তদ্রূপ ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি ধর্ম, সমাজ ও পরিবারের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে।
ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতির স্থিতি ভালো মানুষের ওপর নির্ভর করে। যুগে যুগে মহাপুরুষরা মানুষকে ভালো বা উন্নত মানুষ হওয়ার রাস্তা দেখিয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ আড়াই হাজার বছর আগে এ উপমহাদেশে জনপদ থেকে জনপদে পরিভ্রমণ করে মানুষকে ভালো মানুষ হওয়ার কথা বলতেন। আজকাল সমাজে খারাপ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি, তর্কাতর্কি, নিজের স্বার্থহানি ইত্যাদি ব্যাপারে একজন অন্যজনের ওপর হিংস্ররূপ ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক হানাহানি, জাতিগত দাঙ্গা, নারী, সম্পত্তি ও ক্ষমতা দখল নিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে অহরহ এবং সভ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নগরে-জনপদে, অলিতে-গলিতে মানুষের জীবন বিপদাপন্ন ও নারীর সম্ভ্রম বিপন্ন। মানুষের এ দীনতার কারণে প্রাচ্যের জনৈক মনীষীর মানুষ খুঁজতে দিনের বেলা মশাল নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর ঘটনা হাস্যকর হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। ভালো মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় গোটা বিশ্বে আজ পরিবেশ, নৈতিকতা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। নতুন করে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। মানুষের মন বা চিত্ত হলো সব কিছুর মূল। যেকোনো ভালোমন্দ কাজ করার আগে মনেই তা প্রথমে উদয় হয়। তাই বুদ্ধ মনকে সব কিছুর পূর্বগামী বলেছেন। মানুষের অভ্যন্তরস্থ মন অনবরত ভালোমন্দ নির্বিশেষে মনন বা চিন্তন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে। মানসিক প্রক্রিয়ার পর মানুষ যেকোনো কাজ করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেহেতু সব কুশল-অকুশল কাজ সর্বাগ্রে মনেই উৎপত্তি হয়, তাই মনকে শুদ্ধ করতে পারলে মানুষের যাবতীয় কার্যাবলি শুদ্ধ হয়। তাই বুদ্ধের কণ্ঠে শোনা যায়।
বাচানুরক্খী মনসা সুসংবুতো/কায়েন চ অকুসলং ন করিয়া,/এতে তয়ো কম্মপথে বিসোধয়ে/আরাধয়ে মগগ্মিসিপু পবেদিতং।/(ধর্মপদ-মগগ বগগো-৯)
বাক্যে সংযম রক্ষা করবে, মনে সংযত থাকবে এবং কায়িক অকুশল করবে না। এই ত্রিবিধ কর্মপথ বিশুদ্ধ রাখলে ভালো মানুষ হওয়া যায়। এ পৃথিবীতে আত্মহিত ও পরহিতের উদ্দেশ্যে মানব সভ্যতার সামগ্রিক কল্যাণের জন্য ভ্রাতৃত্ববোধ বিকাশ অপরিহার্য। ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে লোভ, দ্বেষ, হিংসা, হঠকারিতা সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বহুলাংশে হ্রাস পায় অন্যদিকে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিকাশ লাভে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, স্নেহ প্রেম ও নিষ্কাম ভালোবাসার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। মানব সমাজে তখন বেহেশতের আবহাওয়া বিরাজ করে। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি বিকাশের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সুফল মানব জাতির জন্য অপরিসীম বিধায় বৌদ্ধ ধর্মের আদি মধ্য অন্তে শুধু এগুলোর কথা বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের লোভ, দ্বেষ, মোহে আচ্ছন্ন থাকলে কঠোর ও কর্কশ বাক্য বলে থাকে। এতে তাদের মনের স্বচ্ছতা হারিয়ে যায়। আর তা হারিয়ে গেলে নিজের সুখ-শান্তিও হারিয়ে যায়।
'নহি বেরেন বেরানি সমন্তীধ কুদাচনং, অবেরেন চ সম্মস্তি এসধম্মো সনন্তোনো।' অর্থাৎ জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না। মিত্রতার দ্বারা শত্রুতার উপশম হয়।
তাই সুখান্বেষী মানুষের উচিত অন্য প্রাণীদের সুখী হওয়ার পথে অন্তরায় না হয়ে বরং নিজের অর্জিত সুখ অন্যদের কল্যাণের জন্য বিতরণ করা। গৌতম বুদ্ধ ভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মীয় সম্প্রীতিকে একই ছাতার নিচে আনয়ন করে ঘোষণা করেছেন; মাতা যেমন তাঁর নিজের একমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষা করেন তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে, সেরূপ সর্বজীবের প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করো। সন্তানের প্রকৃত মঙ্গলের জন্য মায়ের যে আন্তরিক সদিচ্ছা, এটিই হচ্ছে তথাগত বুদ্ধের মৈত্রী। এই মৈত্রীকে শ্রেষ্ঠতম ভ্রাতৃত্ববোধ বলা যায়। এই মৈত্রী নিছক প্রতিবেশী-সুলভ আচরণ নয়, বরং এখানে প্রতিবেশী ও অন্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক ভ্রাতৃত্ববোধ কেবল যে সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে! আবার এ মৈত্রী তথাকথিত সেই ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ নয়- যেখানে এক ধর্মের লোক শুধু তার স্বধর্মীদের ভালোবাসবে, অন্য ধর্মের লোককে নয়। এই মৈত্রী হলো সেই ভালোবাসা, সেই প্রেম- যেখানে থাকবে না জাতিগত ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ, থাকবে না বর্ণবৈষম্যের বেড়াজাল। থাকবে না ধনী-গরিব, পণ্ডিত-মূর্খ তথা নারী-পুরুষের পার্থক্য। থাকবে শুধু সবার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, ঐকান্তিকতা, থাকবে মানুষ প্রাণী নির্বিশেষে প্রত্যেকের হিতসুখ কামনা। বৌদ্ধদের প্রতিদিনের উচ্চারণ হচ্ছে 'সব্বে সত্ত্বা সুখিতা হোন্ত।'
বুদ্ধের নির্দেশিত এই ব্রহ্মবিহার তথা মৈত্রী ভাবনার মাধ্যমে যে কেউ সুগভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে পারেন এবং হতে পারেন বিশ্ববন্ধু বা বিশ্বপ্রেমিক। এই মৈত্রী একদিকে যেমন মিলন সাধন করে, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মানুষের হৃদয়ের প্রসারতা ঘটায়, ব্যক্তিস্বার্থকে তুচ্ছজ্ঞান করে এবং মানুষের কল্যাণকে পরিব্যাপ্ত করে। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ত্যাগ ও মৈত্রীর দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। বুদ্ধের বিশ্বমৈত্রীর আদর্শ মানুষের সঙ্গে মানুষের কৃত্রিম ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে বিশ্ব মানবতাকে এক মহান ঐক্যবন্ধনের আদর্শে বেঁধে দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জাতিগত, সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিরাম নেই। প্রতি মুহূর্তে মানবতা আজ বিপন্ন। এ অবস্থা দ্বন্দ্বের নিরসন করে স্থায়ী ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধের মৈত্রী কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্মীয় সম্প্রীতির ব্যাপারে বুদ্ধের উচ্চারণ অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন। কালামসুত্তে বৈশালীর কালামদের বুদ্ধ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, 'যেকোনো মতবাদ যাচাই-বাছাই করে নিজের জন্য সুখকর ও কল্যাণকর মনে হলে গ্রহণ করবেন। শাস্ত্রে লেখা আছে, অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ লোক বলছেন বলে কাউকে সম্মান দেখিয়ে কোনো মতবাদ গ্রহণ করবেন না।
বুদ্ধ বলছেন, 'ক্রোধান্বিত হয়ে আপনি অন্যকে অন্যের ধর্মকে আঘাত করে বেশ আনন্দিত হলেন। চিন্তা করে দেখুন তার মনের অবস্থাটা কী হয়েছে। লোকলজ্জা আর হীনমন্যতায় সে নিজেকে কত ছোট ভাবছে তা একবার ভেবে দেখুন তো। সেই একই আঘাত যদি আপনাকে করা হয়, তাহলে আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে? তখন আপনারও খুব খারাপ লাগবে নয় কি? তাই বুদ্ধ মানুষকে পরমতসহিষ্ণুতা শিক্ষা দিয়েছেন, যা অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম অনুঘটক। বুদ্ধ বলেছেন, মানুষ অত্যন্ত উঁচু শ্রেণীর শক্তিশালী প্রাণী। তাই মানুষের প্রতিটি কাজ হবে সুন্দর, স্বচ্ছ, সাবলীল ও গঠনমূলক। বুদ্ধের মতে সমাজ হবে বৈষম্যমুক্ত, সংঘাতমুক্ত যাতে মানুষের সহাবস্থান সুন্দরভাবে নিশ্চিত হবে। তিনি আরো বলেছেন, মানুষ অন্ধ আমিত্ব, অহংবোধ এবং অজ্ঞানই সব অনাসৃষ্টির মূল কারণ।
সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন ও অন্ধ অহংবোধ অবিদ্যার কদর্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও মানুষে মানুষে বৈষম্য পৃথিবীকে নরকে পরিণত করে। তাই বুদ্ধের আহ্বান, কোনো ভেদাভেদ না রেখে মানুষ পরস্পরকে মিত্রজ্ঞানে আলিঙ্গন করবে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। তখন সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প শরতের মেঘের মতো উড়ে যাবে।
তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে অপবিত্র ভেদবুদ্ধির নিষ্ঠুর মূঢ়তা ধর্মের নামে আজ রক্তে পঙ্কিল করে তুলেছে এ ধরাতল। সর্বজীবে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেই তাঁরই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি এই ভ্রাতৃবিদ্বেষ কলুষিত হতভাগ্য দেশে। আজ সেই মহাপুরুষকে স্মরণ করে মনুষ্যত্বের জগদ্ব্যাপী এই অপমানের যুগে বলবার দিন এল 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'। তারই শরণ নেব যিনি আপনার মধ্যে মানুষকে প্রকাশ করেছেন। যিনি সেই মুক্তির কথা বলেছেন, যে মুক্তি রাগ দ্বেষ বর্জনে নয়, সর্বজীবের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রী সাধনায়। আজ স্বার্থ ক্ষুধান্ধ বৈশ্যবৃত্তির নির্মম নিঃসীম লুব্ধতার দিনে সেই বুদ্ধের শরণ কামনা করি, যিনি আপনার মধ্যে বিশ্বমানবের সত্যরূপ প্রকাশ করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।"
লেখক : সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

No comments

Powered by Blogger.