শেকড়ের ডাক-বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়ে যাবে by ফরহাদ মাহমুদ

অনেক মন্দের ভেতরেও যখন দেশের দু-একটা সুখবর পাওয়া যায়, তখন একজন বাংলাদেশি হিসেবে প্রাণটা ভরে যায়। তাই তো ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ বড় কোনো দলকে হারিয়ে দিলে রাস্তায় নেমে যায় আনন্দিত মানুষের ঢল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার খবরে সারা দেশ আনন্দে নেচে ওঠে।


কিংবা বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পাটের জেনোম আবিষ্কার করায় আমরা আবেগে আপ্লুত হই। তত বড় না হলেও চলতি মাসে আরেকটি আনন্দদায়ক খবর বেরিয়েছে। তা হলো, আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি'স-এর রেটিংয়ে এবারও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় হয়েছে। এক নম্বরে আছে ভারত। শ্রীলঙ্কা এক পয়েন্ট এবং পাকিস্তান তিন পয়েন্ট কম পেয়ে এই রেটিংয়ে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও এই পাকিস্তান শিল্পায়নে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। নতুন এই রেটিংয়ের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অধিকতর সুবিধা পাবে।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ থাকার কারণে এবার রেটিংয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, এ ব্যাপারে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। যা হোক, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে_এটাই সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়। তার একটি বড় কারণ, বিগত রেটিংয়ের সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে যে তিনটি সমালোচনা ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রপ্তানি ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা। গত এক বছরে পোশাকের বাইরেও বেশ কিছু পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল সন্তোষজনক। কেবল জাহাজ নির্মাণ শিল্পেই বাংলাদেশ এ বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ পেয়েছে। অন্য সব সমালোচনার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। যেমন_কর আদায়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিটকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর আইন আধুনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, মুডি'স রিপোর্টে তাকেও ইতিবাচকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের ঘটনা নিয়েও কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুডি'স ইনভেস্টরস সার্ভিসের 'ক্রেডিট অ্যানালাইস : বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনে এগুলোকে অপপ্রচার এবং সম্পূর্ণ অমূলক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বলেছে, ড. ইউনূসের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা একটি আইনসম্মত পদক্ষেপ। এ বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলার প্রশ্নই ওঠে না।
বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৬ কোটি। এই বিশাল জনসংখ্যার কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য দেশে শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত করার কোনো বিকল্প নেই। সেদিক থেকে বর্তমান সরকারের গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক। '৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামল থেকেই বাংলাদেশের পাট শিল্প দেশি-বিদেশি নানা রকম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে আদমজী, বাওয়ানীসহ যে ৭৭টি পাটকল ছিল, এখন তার এক-চতুর্থাংশও চালু নেই। বড় পাটকলগুলোর প্রায় সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং নামমাত্র মূল্যে বেসরকারি মালিকানায় বিক্রি করা হয়েছে, যাকে বিক্রি না বলে লুটপাট বলাটাই বোধ করি যুক্তিসংগত হবে। ১৯৯১ সালের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী এর আগে বিক্রি করা ২৯টি পাটকলের মূল্য ছিল ২৪৫ কোটি টাকার ওপরে, কিন্তু সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে খুলনার খালিশপুরে অবস্থিত পিপলস জুট মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। গত ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালিশপুর জুট মিল নামে সেই জুট মিলটি পুনরায় চালু করেছেন। জুট মিলটি নতুন করে উদ্বোধনের সময় তিনি ঘোষণা করেন, বন্ধ থাকা আরো সাতটি পাটকল দ্রুত চালু করা হবে। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সারা দুনিয়ায় আজ পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ অবস্থায় আমাদের পাট শিল্প পিছিয়ে থাকতে পারে না। পাট আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচিতির অংশ। আমরা পাটের জেনোম আবিষ্কার করেছি। উন্নত পাটবীজ উৎপাদনের গবেষণা চলছে। পাটজাত পণ্যের উৎকর্ষের জন্যও ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে পাট শিল্পসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে আমরা এগিয়ে যাবই।
সম্প্রতি বাংলাদেশে জাহাজ শিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আগেই বলেছি, চলতি অর্থবছরেও বাংলাদেশ ৫০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ পেয়েছে। এখনই এ শিল্পে কয়েক লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই একটি শিল্প থেকেই বাংলাদেশ অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারবে। অবশ্য পরিবেশদূষণ ও দুর্ঘটনায় শ্রমিক-মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে জাহাজ শিল্পের অনেক সমালোচনা আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সমালোচনা ও সম্ভাবনার মধ্যে একটি সেতুবন্ধ রচনা করতে হবে। অনেক মালিকের পক্ষে এককভাবে দূষণনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন সম্ভব হয় না। মালিকদের অংশগ্রহণে সরকার সেখানকার পরিবেশদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে সরকার মালিকদের বাধ্য করবে। প্রয়োজনবোধে সরকার সেখানে মালিকদের সহায়তা করবে। কিন্তু এই শিল্পের সম্ভাবনাকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না, যথাসাধ্য একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ওষুধ, চামড়া, সিরামিক শিল্পসহ আরো অনেক শিল্পই যথেষ্ট পরিমাণে এগিয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা হয়েছে মূলত ব্যক্তি-উদ্যোগ থেকে। সরকারি উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা সেখানে খুবই নগণ্য। সরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব শিল্পও আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে_এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার শিল্পায়নের জন্য রাস্তাঘাট বা অবকাঠামো যেমন প্রয়োজন, তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ থাকা প্রয়োজন। এ দেশে শিল্পায়ন পর্যাপ্ত না হওয়ার প্রধান কারণই এগুলো। দীর্ঘ বিরতির পর বর্তমান সরকার দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। পাশাপাশি দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা দূর করতে না পারলেও শিল্পায়ন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। সরকারকে সেদিকেও নজর দিতে হবে।
তবে একটি কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ এখনো একটি কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবেই পরিচিত। যদিও কৃষিতে একর বা হেক্টরপ্রতি উৎপাদনে উন্নত অনেক দেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে, ২০০৯ সালে চীনে হেক্টরপ্রতি ধান উৎপন্ন হয়েছে ৬ দশমিক ৫৯ মেট্রিক টন, ভিয়েতনামে ৫ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৫ মেট্রিক টন। সে বছর বিশ্বে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ৪ দশমিক ২০ মেট্রিক টন। অথচ একই সালে বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ৩ দশমিক ৯২ মেট্রিক টন। আর ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপন্ন হয়েছিল হেক্টরপ্রতি ৩ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন। সে ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। মাছ বা চিংড়ি উৎপাদনেও বাংলাদেশের একরপ্রতি উৎপাদন অনেক কম। নিজস্ব হাইব্রিড বীজ উৎপাদনব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে প্রতিবছর বাইরে থেকে বীজ আমদানি করতে হয়। দেখা যায়, প্রায়ই নিম্নমানের বীজ আমদানির ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বছরও ব্র্যাক, এনার্জিপ্যাকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ঝলক, সারথি ও অন্যান্য জাতের ধানের বীজ ব্যবহার করে সারা দেশে কয়েক লাখ কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। ধানবিজ্ঞানীদের বেশ কয়েকটি টিম মাঠপর্যায়ে গিয়ে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগাক্রান্ত বীজ ব্যবহার করার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আবার কেউ কেউ এর জন্য আবহাওয়ার তারতম্য এবং অতিরিক্ত পরিমাণে সার ব্যবহারকে দায়ী করেছেন। শুধু ধান নয়, আলু, গম, ভুট্টাসহ আরো অনেক বীজের ক্ষেত্রে প্রায়ই এ সমস্যা দেখা যায়। তাই এসব ক্ষেত্রে কৃষককে বাঁচাতে এবং কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অপরীক্ষিত বীজ যাতে কৃষকরা ব্যবহার না করেন এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন_সে জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পাশাপাশি দেশেই উন্নতমানের বীজ উৎপাদনেরও উদ্যোগ নিতে হবে।
আবার কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এ দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের পরিমাণ খুবই কম। এমনকি কোল্ডস্টোরেজ বা সংরক্ষণ ব্যবস্থাও যথেষ্ট পরিমাণে গড়ে ওঠেনি। ফলে উৎপাদন মৌসুমে আলু, টমেটো, আনারস ইত্যাদি সংরক্ষণ করা যায় না। এ কারণে প্রতিবছরই কৃষকদের আর্থিক ক্ষতিসহ নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি-উদ্যোগকে উৎসাহী করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার দেশের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.