বহে কাল নিরবধি-দুঃসংবাদের দিবারাত্রি by এম আবদুল হাফিজ

ক্যালেন্ডারের পাতায় বসন্ত বিরাজ করার সময় থেকেই আমরা গ্রীষ্মের রুদ্ররোষকবলিত। অকাল গ্রীষ্মের খরতাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো বিহিত নেই। ফলে নশ্বরজীবনের একটি বিরাট অংশই কেটে যায় বিদ্যুৎহীনতায়।


'শরীরের নাম মহাশয়; যা সহাবে, তা-ই সয়'_ভাগ্যিস এই আপ্তবাক্যটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, তাই রক্ষে। নির্বুদ্ধিতার বশবর্তী হয়ে গত সপ্তাহে একটি মামুলি অস্ত্রোপচার করিয়েছিলাম। ডাক্তারের নির্দেশমতো সেলাই না কাটা পর্যন্ত ক্ষতটি ভেজানো যাবে না। তাই ঘর্মাক্ত কলেবরে স্নান থেকে বিরত থাকা তো এক দুর্ভোগ।
দ্বিতীয় দুর্ভোগটি উপনীত হয় সূর্যাস্তের পর, যখন সারা দিনের অস্বস্তি ও কর্মব্যস্ততার পর খুঁটে খুঁটে সংবাদপত্রগুলো পড়তে ইচ্ছা করি। কয়েক দিন ধরে লোডশেডিংয়ের হাত থেকেও রেহাই নেই, যদিও লোকে ঈর্ষা করে যে, আমরা নাকি প্রতিরক্ষা আবাসিক সোসাইটির 'অভিজাত' এলাকায় বাস করি। সন্ধ্যা গড়ালেই যখন কাগজপত্র নিয়ে বসি কিছু লিখব বা পড়ব বলে, একেবারে বেরসিকভাবে বিনা নোটিশে বিদ্যুৎ সেই যে বিদায় নেয়, একটি গুমোটের ভেতর প্রায় দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে দিই। অন্ধকারে হারানো কিছু হাতড়াতে গিয়ে কতবার যে হোঁচট খাই, অন্ধকারে কোনো কিছু ঠাহর করতে গিয়ে কাচের বাটি বা পেয়ালা ভাঙি, তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। প্রায় এক যুগের মতো সময়জুড়ে এ দুর্ভোগের শিকার হয়ে আছি আমরা। কাকে কী বলব, তারাই বা কী করবে। তাই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে শরীর এলিয়ে রাজ্যের সাতপাঁচ ভাবি। ভাবি দেশের কথা, রাজনীতির কথা, রাজনীতিকদের ফুলঝুরি প্রতিশ্রুতির কথা। ভাবি প্রবঞ্চনার কথা, আমাদের অসহায়ত্বের কথা।
যখন সংবাদপত্র খুলি (দিনের বেলায়) এত দুঃসংবাদে তা ঠাসা থাকে যে কিছুক্ষণ পর আর পড়ার ইচ্ছা থাকে না। বরং তা গুটিয়ে রেখে কল্পনাবিলাসে প্রবৃত্ত হই। অলীক সব কল্পনা। এই যে আমাদের দেশটা মধ্যযুগের অপরাধে নিমজ্জিত হয়েছে, দেশে একটি শক্তিশালী সরকার থাকা সত্ত্বেও নৈতিকতার এই যে অবক্ষয়, যেখানে বন্ধুত্ব বা স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন বা পারিবারিক-মানবিক সুকুমারবৃত্তিগুলো ঝরা ফুলের মতো ঝরে যাচ্ছে, সমাজ, সরকার বা পরিবারের জ্যেষ্ঠদের কি সেখানে কিছুই করার নেই? আমরা কি আদিম যুগের জঙ্গলে বাস করছি?
এত সুন্দর মোলায়েম মাটির আমাদের দেশটা, তা কি মানুষরূপী সরীসৃপে ভরে গেছে? সৎ উপার্জনে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা নেই এখানে। অসংখ্য দুঃসংবাদে সংবাদপত্রের পাতা ছেয়ে যায় প্রতিদিন_এত মৃত্যু, অপমৃত্যু, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়! রাজনৈতিক কোন্দল, স্বার্থোদ্ধার এবং প্রাপ্য আদায়ে অন্তর্দলীয় বিরোধ ইত্যাদির কথা ছেড়েই দিলাম। এ ছাড়াও তো বিদেশিদের বা প্রতিবেশীদের লোলুপ দৃষ্টি আমাদের স্বার্থকে পদে পদে বিঘি্নত করছে।
এক ভোগবাদী দেশ! যার আছে তো আছেই, যার নেই সে পথের ভিখারি। কর্মসংস্থানের বড় বড় কথা শুনলাম। তার জন্যও একজনকে রমিজা হতে হবে। কিন্তু সেটা তো বাস্তবসম্মত নয়। দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে অনন্তকালের কাইজ্যা, যার মাসুল দিচ্ছি আমরা। এর অবসান হলে দেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে যেত। কে কাকে তা বোঝাবে? বরং সংবিধান সংশোধন ইস্যুসহ ঘোষিত বা অঘোষিত আরো বহু ইস্যুতে দুই শীর্ষ দলের মতপার্থক্য বাড়ছেই। এদিকে অসাধুরা বেপরোয়া। অপরাধী চক্রের সদস্যরা অপরাধজগতের সম্রাট, যেখানকার আধিপত্য এদের এনে দেয় অবিশ্বাস্য ভাগ্যোন্নয়নের আলাদিনের চেরাগ!
মাঝেমধ্যে অন্ধকারে বসে বসে ভাবি, সমাজটাকে পাল্টে দিতে বা রাজনীতির গুণগত মানোন্নয়নে এখানেও কি আরব বিশ্বের মতো গণতন্ত্রের বসন্ত এবং তার পুষ্পায়ন ঘটতে পারে না। অলীক সব চিন্তা এবং বিদ্যুৎবিহীন অলস অন্ধকারে সেটাই তো স্বাভাবিক। এ অন্ধকারই হয়তো একদিন উদ্ভব ঘটাবে এমন এক দানবের, যা তিউনিস ঘটাবে, তাহরির স্কয়ার ঘটাবে। আমাদের এই দীর্ঘ পুরনো সমাজ, রাজনীতি, দুর্নীতি, দারিদ্র্য বা বৈষম্যের মতো পুঙ্গবদের নির্মূল করবে।
বিশ্বাস করুন, গভীর রাতের এক ক্লান্ত প্রহরে অতঃপর 'অবিশ্বাস'-এর মতো বিদ্যুৎ এসে যায়। ভেঙে দেয় আমার কল্পনাবিলাস। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে টেলিভিশন চালিয়ে দেখি, মুখ্য সময়ের (চৎরসব ঃরসব) সব প্রোগ্রাম শেষ। তবে দিনের শেষ খবরগুলো তখনো প্রদর্শন হওয়া বাকি। আমার প্রিয় কোনো চ্যানেলে আমি তখন শেষ সময়ের খবর দেখি।
শেষ খবর প্রচারিত হওয়ার সময় উপস্থাপিকা বা সংবাদ পাঠিকারাও ক্লান্ত। কিন্তু তাঁদের নিয়মিত ডিউটি করতে হয়। টেলিভিশনের পর্দায় এই সময় নিচের অংশে ফুটনোটের মতো করে সারা দিনের দুঃসংবাদগুলো আবার পরিবেশিত হয়; কতকটা সারসংক্ষেপের মতো। সড়ক দুর্ঘটনায় কয়জন মরল, কয়জন কোথায় দুষ্কৃতকারীর হাতে নিহত হলো, কার কত টাকা ছিনতাই হলো, কোথায় কে সম্ভ্রমের খাতিরে আত্মহত্যা করল, কোথায় কোন অগি্নকাণ্ডে কতজন দগ্ধ হলো ইত্যাদি। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত প্রতিদিনকার দুঃসংবাদ আর যা-ই হোক, দেশের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরে।
তবে এখানেও প্রটোকলের ব্যাপার আছে। দুঃসংবাদের শিকারের পদমর্যাদা অনুযায়ীই তার সম্পর্কে সংবাদের আয়তন নির্ধারিত হয়। ট্রাক উল্টে নিহতদের শুধু একটি পরিসংখ্যানই থাকে। অথচ এ দেশটির জন্য তাদেরও হয়তো ভালোবাসা ছিল, আবেগ ছিল। কিন্তু সেগুলো এখন গৌণ। এমনিভাবে প্রতিদিন এ দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ তাদের প্রিয় দেশে পরিচিতি হারিয়ে শুধু পরিসংখ্যানে পরিণত হয়। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে একটি অকাল গ্রীষ্মের রাতে যখন এই দুঃসংবাদগুলো দেখি, রাতের অবশিষ্ট অংশে তা শুধু দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএমএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.