আদালতের নির্দেশ মানছে না প্রশাসন অবাধে চলছে শিশু ভিক্ষাবৃত্তি

উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে বন্ধ করতে পারেনি শিশু ভিক্ষাবৃত্তি। এখনও বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল।

আর উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও ডিএমপি অধ্যাদেশ অনুসারে শিশু ভিক্ষাবৃত্তিসহ সকল প্রকার ভিক্ষাবৃত্তি অবৈধ ও বেআইনি হলেও পুলিশের সামনেই চলছে এসব কর্মকাণ্ড। ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন দৈনিকে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকার শিশু নিয়ামুলকে অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। আদালত ঘটনাটি অবগত হয়ে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি শিশু ভিক্ষাবৃত্তিসহ সকল প্রকার ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ একটি স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন।
এই রুলের পরিপ্রেক্ষিতে  একই বছরের ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের উক্ত বেঞ্চ রাজধানীসহ দেশের সকল স্থানে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে পুলিশের মহাপরিচালক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশ দেন। একই সাথে রাজধানীতে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেন আদালত।

আদালতের নির্দেশের পর একই বছরের ১৪ জানুয়ারি ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শওকত মোস্তাফাকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলম আরা ও সাঈদ মোহাম্মদ বেলাল হায়দার।  এই কমিটি ভিক্ষাবৃত্তির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া  এবং ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে সুপারিশ করে।

তবে সরকারের এতো কিছুর পরও বন্ধ হয়নি শিশু ভিক্ষাবৃত্তি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপথে ওপর বিকালাঙ্গ ও অসুস্থ শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব শিশুর মা দাবিদার মহিলাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের সম্পর্কের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় না।

গত শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে ফুটপাথের ওপর তিনটি শিশুকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়।  পাশে বসে সাহায্যের জন্য পথচারীদের কাছে ভিক্ষার চাচ্ছিলেন ৩০-৩২ বছর বয়সী এক মহিলা। গ্রীষ্মের তীব্র রোদে ফুটপথের ওপর এই তিনটি বাচ্চার গভীর ঘুম নিয়ে সন্দেহ হলে ভিক্ষারত মহিলাকে তার নাম ও বাচ্চাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করা হয়। এসময় এই মহিলা তার নাম ও বর্তমান ঠিকানা বলতে চাননি। বাচ্চা তিনটি তার নিজের বলে দাবি করে বলেন, তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা। স্বামী কাঁচা তরকারি দোকানদার ছিলেন। ছয় মাস আগে স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বাচ্চাদের ভরণ-পোষণের জন্য বাধ্য হয়ে তাকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে।

তবে বাচ্চা তিনটি বয়স একই  মনে হওয়ায় তাদের নাম ও বয়স জিজ্ঞাসা করা হলে সে এলোমেলো তথ্য দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে একটি বাচ্চা তার বড় বোনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু দিন আগে তার বোনকে তালাক দিয়ে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেছে, তাই এখন বোনের সংসার খরচও তাকে দিতে হয়।

মহিলাটির এমন তথ্যের সত্যতা প্রমাণে জন্য তার বর্তমান ঠিকানায় নিয়ে যেতে বললে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে বলেন, ‘‘ভিক্ষা দিতে ইচ্ছা হলে দেন না হলে এতো পেঁচাবেন না।’’

রাজধানীর কাওয়ানবাজারের আন্ডারপাসের মধ্যে বসে সাত আট  বছরের একটি অন্ধ মেয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। মেয়েটিকে তার নাম, পরিচয় বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সে কোনো উত্তর দেয় না। প্রতিদিন সকাল ৮টা সময় কেউ একজন বাচ্চাটাকে সেখানে বসিয়ে রেখে যায় আর রাত ১১টার দিকে এসে নিয়ে যায় বলে জানান আন্ডারপাসের মধ্যে ওজন ও উচ্চতা মাপার ব্যবসায়ী মোখলেস আলি। তিনি বার্তা২৪ ডটনেটকে বলেন, ‘‘বাচ্চাটাকে সকালে কেউ একজন এখানে রেখে যায়, দুপুর বেলা একজন এসে তাকে খাইয়ে দেয় আর ভিক্ষার টাকাগুলো নিয়ে যায়। তবে লোকটি সবসময় আন্ডারপাসের আশেপাশেই থাকে।’’
   
নয়াপল্টন ও কাওরানবাজারের মতো এমন চিত্র দেখা যায় মতিঝিল, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, শাহবাগ, গুলিস্থান ও পল্টনে।

আদালতে সরাসরি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রাজধানী পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা হলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বার্তা২৪ ডটনেটকে বলেন, ‘‘ডিএমপি অধ্যাদেশ অনুসারে শিশু ভিক্ষাবৃত্তিসহ সকল প্রকার ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তাছাড়াও এই অধ্যাদেশটি কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের একটি আদেশও রয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশের এ ধরণের ভূমিকা অবশ্যই আদালত অবমাননার শামিল হবে।’’

এলিনা খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে অনেক আইন রয়েছে। কিন্তু আইন অমান্য করার প্রবণতা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। এই যদি হয় দেশের অবস্থা তাহলে শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, সকল প্রকার আইন অমান্য করার প্রবণতা বেড়ে যাবে।’’

এলিনা খান আরো জানান, ‘‘আদালত শিশু নিয়ামুলকে অঙ্গহানিসহ এধরণের অপরাধে সম্পৃক্তদেরও খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই সময় বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে সরকার আদালতের কাছে সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।’’

এলিনা খান বলেন, ‘‘এভাবে ভিক্ষাবৃত্তি চলতে থাকায় এসব কাজে পুলিশের সহযোগিতার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করছে।’’

No comments

Powered by Blogger.