বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৯৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। ইমাম-উজ-জামান, বীর বিক্রম সাহসী ও সফল এক যোদ্ধা ৬ নভেম্বর ১৯৭১। মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাবসেক্টরের হেডকোয়ার্টার্সে ডাক পড়ল ইমাম-উজ-জামানের। তখন বিলোনিয়া পকেট পুরোপুরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে।


তাঁর ওপর ভার পড়ল বিলোনিয়া রেলস্টেশন থেকে শুরু করে ফেনী পর্যন্ত পকেটটি মুক্ত করার। পরশুরাম, চিথলিয়া, ফুলগাজী, মুন্সিরহাটে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের মজবুত ঘাঁটি। সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল হীরা তাঁকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।
দায়িত্ব পেয়েই ইমাম-উজ-জামান প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। তাঁর অধীনে নবগঠিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের ৮০ শতাংশ পেশাদার, বাকি ২০ শতাংশ স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত। সিদ্ধান্ত নিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে ভারতে থেকে গোপনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবেন। যাতে ভোর হওয়ার আগেই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই শুরু করা যায়। শীতের রাত। সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হিমেল হাওয়া আর গাছের পাতায় কেমন যেন শব্দ। মনে হচ্ছে রাতটা যেন কোনো কিছুর প্রতীক্ষায় আছে।
বিলোনিয়ার তিন দিকই ভারত সীমান্তে পরিবেষ্টিত। তাই ইমাম-উজ-জামান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতের এক প্রাপ্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম-চিথলিয়ার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার। এ অবরোধ যদি সফল হয়, তবে শত্রু পাকিস্তানি সেনারা সহজেই ফাঁদে আটকা পড়বে।
রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা। মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রবেশ শুরু করলেন। পাকিস্তানি সেনারা বুঝতেও পারল না, তাদের জালে আটকানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে। নিঃশব্দে সবাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছেন। মুহুরী নদী ও আরেক নদীর কোথাও বুক, কোথাও কোমর পানি। পিচ্ছিল রাস্তা। অন্ধকারে কাছেও কিছু দেখা যায় না। ভোর হওয়ার আগেই সব কাজ শেষ হয়ে গেল। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধের মধ্যে। ইমাম-উজ-জামানের কাছ থেকে খবরটা শুনে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত।
তারপর সকাল থেকে বিলোনিয়ার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ শুরু হলো। ইমাম-উজ-জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দুই দিন যুদ্ধের পর বিলোনিয়ার বিরাট এলাকা মুক্ত করলেন। ৮০ শতাংশ পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হলো। অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখা গেল পাকিস্তানি সেনাদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে। চারদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। ধানখেত, বাংকার, খাল কোথাও ফাঁক নেই। লাশের ফাঁকে আহত অনেকে কাতরাচ্ছে বাঁচার আশায়।
ইমাম-উজ-জামান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে নবীন সেনা কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট) হিসেবে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসে ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টে। ২৫ মার্চ রাতে তাঁকে আরও কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে বন্দী করা হয়। ৩০ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বন্দী অবস্থায় গুলি করে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান। পরে কৌশলে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে একটি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজনগর সাবসেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য ইমাম-উজ-জামানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬।
ইমাম-উজ-জামান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ২০০৩ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর নেন। তখন তিনি বগুড়া সেনানিবাসের জিওসি ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায়। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার মহাখালী নতুন ডিওএইচএসে। তাঁর বাবার নাম মোদাচ্ছের আলী চৌধুরী। মা মাহমুদুনেছা বেগম। স্ত্রী ইসরাত ইমাম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: ইমাম-উজ-জামান, বীর প্রতীক, রাফিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.