গোলটেবিল বৈঠক-বেড়ে ওঠার ভালো পরিবেশ চায় বস্তিবাসী শিশুরা

বস্তিবাসী শিশু রুমা বলে, ‘মা পড়ার জন্য স্কুলে পাঠাইতে পারে নাই। কাগজ টুকাইতে দিছে। এ কাম করতে অনেক খারাপ লাগে। কারও গায়ে একটু বস্তা লাগলেও চড় দেয়।’ এ কথা বলে রুমা খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
জীবন বলে, ‘বস্তিতে পানির জন্য লাইন দিতে হয়। সকালে মুখ ধোয়ারও সুযোগ পাওয়া যায় না। মুখ না ধুইয়্যা ইস্কুলে গেলে মাস্টার মাইর দেয়।’


গতকাল সোমবার বস্তিবাসী সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এ কথাগুলো বলে প্রথম আলো আয়োজিত ‘নগর জীবনে শিশুরা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে। এতে এ শিশুরাই ছিল মূল বক্তা। প্রথম আলো কার্যালয়ে বৈঠকটি আয়োজনে সার্বিক সহায়তা করে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। বৈঠকে শিশুরা খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, বিকাশ, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা, মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, নিরাপত্তার অভাবসহ নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে। তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শোনেন ও শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার অবৈধ দখলে থাকা খেলার মাঠগুলো খেলার উপযোগী করছে। এখন আর কোনো খেলার মাঠ কেউ অন্য কাজে ব্যবহার করতে তেমন সাহস পাচ্ছে না। এ সময় ছোট্ট আসলাম প্রতিমন্ত্রীকে অনেকটা থামিয়ে দিয়ে জানাল, লালবাগে বাইদ্যাপট্টি হিসেবে পরিচিত এলাকার কাছে যে মাঠটি আছে, সেটি ট্রাকস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রতিমন্ত্রী এ মাঠটি দখলমুক্ত করার অঙ্গীকার করেন। এভাবে কখনো প্রতিমন্ত্রী আবার কখনো শিশুরা কথা বলে বৈঠকে। এ শিশুরা কি আরেকটু ভালো পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ পেতে পারে না? শিশুদের এ প্রশ্নও ছিল প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
জাহাঙ্গীর কবির নানক শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এ শিশুরাই আগামী দিনে দেশকে বাঁচিয়ে রাখবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এদের জন্য মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি এনজিও, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শিশুদের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে আমার চেতনার জায়গা অনেকটাই খুলে গেছে। এদের সচেতনতা দেখে এখানে বসেই সুন্দর একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি।’ তিনি বলেন, কাঁটাবন বস্তিতে জন্ম নেওয়া শিশু আর গুলশানে জন্ম নেওয়া শিশুর অধিকার সমান। বস্তিতে জন্মানো শিশুটি যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় টোকাই হিসেবে বেড়ে না ওঠে, গুলশানে জন্মানো শিশুটির মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, সে ধরনের পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে। শিশুদের জন্য সরকারের নেওয়া লালবাগে সুবিধাবঞ্চিত ৫০০ শিশুকে মাসিক এক হাজার ৫০০ টাকা সহায়তা দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী।
টিঅ্যান্ডটি কলোনির সম্রাট বলে, বস্তি উচ্ছেদে শিশুরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় থাকার ফলে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়। বিকল্প থাকার ব্যবস্থা করে বস্তি উচ্ছেদ করা যায় কি না, প্রতিমন্ত্রীর কাছে সে জানতে চায়।
ফকিরাপুলের মর্জিনা জানায়, তার পরিবারের আটজন সদস্য ছোট্ট একটি ঘরে থাকে। এ ঘরের ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। তার দাবি ছিল, কম টাকায় ভালো জায়গায় বাসস্থান।
ফকিরাপুলের জীবন হোসেন বলে, বস্তির শিশুরা একটু বড় হলেই বাবা-মা বলে, ‘তোমরা তোমার খাবার জোগাও।’ শিশুরা বাড়ির বাইরে পা দিয়ে নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কিছু টাকার লোভে কিছু না বুঝেই মাদকের প্যাকেট বহন করে। পুলিশ ধরে, তখন সত্য কথা বললেও পুলিশ তা বিশ্বাস করে না।
চানখাঁরপুলের মনি ও পুরান ঢাকার মাহমুদুল হাসান জানায়, একটু বৃষ্টি হলেই তাদের ঘর, স্কুল, বাজার সব তলিয়ে যায়।
কেরানীগঞ্জের রুবেল হোসেন বলে, বস্তির কাছাকাছি সরকারি হাসপাতাল নেই। অন্য হাসপাতালে গেলে টাকা নেই বলে চিকিৎসা করতে চায় না। বাড়িতে কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে চিকিৎসক এ নোংরা জায়গায় আসতে চান না।
পুরান ঢাকার আসলাম জানায়, এলাকার কলকারখানার শব্দে পড়াশোনার অসুবিধা হয়, ঘুমানো যায় না। ফকিরাপুলের সোমা বলে, স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বাজে ছেলেরা বিরক্ত করে। ঘরের পাশে গান বাজায়। এ সমস্যার কথা মা-বাবাকে বললে বিয়ে দিয়ে দেয়।
কেরানীগঞ্জের মুক্তা জানায়, বস্তিতে গোসলের জন্য আলাদা কোনো জায়গা না থাকায় খোলা জায়গায় সবার সামনে গোসল করতে লজ্জা লাগে। বস্তিতে টয়লেটও নেই।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার পাশাপাশি সিলভিয়া এটিএন বাংলায় খুদে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছে। তার মতে, বস্তির শিশুদের মেধা আছে। কিন্তু সবাই স্কুলে যেতে পারছে না।
পুরান ঢাকার মাইনুল হোসেন বলে, বস্তিতে আগুন লাগে। পত্রিকায় লেখা হয়। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারি খাসজমিতে গড়ে ওঠা বস্তি ঘিরে সরকারি দলের একটি চক্র সক্রিয় থাকে। তারাই বস্তি দখলের জন্য আগুন লাগায়।
বৈঠকে পপি, সাথী, সালমাও বস্তি থেকে শিশু পাচার, শিশুর নিরাপত্তাহীনতাসহ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে।
বৈঠকে নগর গবেষক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এ শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে। নগর পরিকল্পনার মধ্যেই নগরের দরিদ্র মানুষের বাসস্থান, শিশুদের কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকায় দেড় কোটি লোক বাস করে। এর মধ্যে বস্তিবাসীর সংখ্যা ৪০ লাখ। আগারগাঁও বস্তি, করাইল বস্তি ভাঙা তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন সেখানে বসবাসরত মানুষের যথাযথ পুনর্বাসন করা হবে। পুনর্বাসন না করে বস্তি উচ্ছেদ ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও মারাত্মক। কোনোভাবেই মানুষের থাকার অধিকারকে ধ্বংস করা যাবে না।
প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকও বলেন, পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর। যার যেখানে যা খুশি, তা-ই তৈরি করছে। ফলে আস্তে আস্তে শহরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
সরকারের সীমাবদ্ধতা, নগর পরিকল্পনায় ত্রুটি, জনসংখ্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও বৈঠকের সঞ্চালক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নির্যাতন ও অবহেলায় বস্তিবাসী শিশুদের মধ্যে শিশুসুলভ স্বাভাবিক আচরণ যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে সবার দৃষ্টি রাখতে হবে।
বৈঠকের একপর্যায়ে আসলামের কাছে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গান বা কবিতা শুনতে চান। সঙ্গে সঙ্গে আসলাম ‘আমরা শিশু, আমাদের আছে অধিকার, মেহনতের কাজ করব না আর...এসো সবাই ইস্কুলে যাই’ গানটি গাওয়া শুরু করে। উপস্থিত সব শিশুই আসলামের সঙ্গে গলা মেলায়।

No comments

Powered by Blogger.