জ্বালানি-কোটি টাকার গ্যাস হারিয়ে কাঠগড়ায় বাংলাদেশ by বদরূল ইমাম

বিদেশি তেল গ্যাস কোম্পানি নাইকো রিসোর্স লিমিটেড ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে (টেংরাটিলা) ২০০৫ সালে পর পর দুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন করে, তার বিপরীতে বাংলাদেশ সরকার নাইকোর কাছে ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।


ছয় বছর পার হয়ে গেলেও নাইকো এ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি কিংবা বাংলাদেশও নাইকোকে এই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে নাইকো কর্তৃক ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহ বাবদ পাওনা ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে বাংলাদেশ বিরত থাকে। নাইকো এ টাকা পরিশোধ না করার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে মামলার শুনানি শুরু হবে।
নাইকো ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সালিসি প্রতিষ্ঠান আইসিএসআইডির (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট) আদালতে গত জুলাই মাসে মামলাটি করে। এ লক্ষ্যে আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল গঠন সম্পন্ন হয় গত ডিসেম্বর মাসে। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে একজন প্রেসিডেন্ট জার্মানির নাগরিক এবং দুজন আরবিট্রেটর অর্থাৎ নাইকোর প্রস্তাবে ফ্রান্সের একজন এবং বাংলাদেশের প্রস্তাবে নিউজিল্যান্ডের একজন নাগরিককে নিয়োগ করা হয়। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ও নাইকো তাদের পক্ষে মামলা চালানোর জন্য নিজ নিজ আইনজীবী নিয়োগ করেছে। মামলায় বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে বিবাদী করা হয়। নাইকো একই আদালতে দ্বিতীয় একটি মামলা করে বাংলাদেশ কর্তৃক ক্ষতিপূরণ দাবির বিপক্ষে। বাংলাদেশের জন্য মামলাগুলোর ফলাফল কেবল আর্থিক কারণেই অতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বাংলাদেশে নাইকোর বিতর্কিত আগমন ও কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষাও অতি গুরুত্বপূর্ণ।
নাইকো রিসোর্স লিমিটেড কানাডার একটি ক্ষুদ্র ও অখ্যাত তেল কোম্পানি। কানাডার ক্যালগেরি শহরে এটির হেড অফিস থাকলেও কানাডার তেল-গ্যাস কার্যক্রমে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ কোম্পানির কার্যক্রম কেবল স্বল্প পরিসরে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, কুর্দিস্তান ও ত্রিনিদাদে বিস্তৃত। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানির বৃহৎ গ্যাস ব্লকসমূহে নাইকোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অংশীদারি (অপারেটর নয়) থাকার সুবাদে তার উত্থান। ১৯৯০-এর দশকে নাইকোর চোখ পড়ে বাংলাদেশের ওপর। সে সময় অন্যান্য বিদেশি তেল কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আর্থিক ও কারিগরিভাবে অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার কারণে এ দেশে আসতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আইনবহির্ভূত পন্থায় এক দুর্নীতিগ্রস্ত মহলের যোগসাজশে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে নাইকো কোম্পানির খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ২০০৩ সালে সরকারের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার অ্যাগ্রিমেন্ট (জেভিএ) চুক্তির মাধ্যমে নাইকো বিনা প্রতিযোগিতায় ছাতক ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র দুটি বাগিয়ে নেয়, যাতে মজুদ গ্যাসের দাম প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা)। বিষয়টি যে এ দেশের সরকারি-বেসরকারি মহলে অজানা ছিল, তা মোটেই নয়, অধিকন্তু বিষয়টি এতটাই নগ্ন ছিল যে পরবর্তী কোনো এক সময় কানাডার ফেডারেল পুলিশ নাইকোর বিরুদ্ধে উপরিউক্ত চুক্তি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ঘুষ দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত হাতে নেয়।
২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের টেংরাটিলায় কূপ খনন করতে গিয়ে প্রথম দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণ ঘটায়। একই বছর জুলাই মাসে নাইকো রিলিফ কূপ খনন করতে গিয়ে পুনরায় দুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণ ঘটায়। দুটি দুর্ঘটনায় বিপুল গ্যাস সম্পদ, ব্যক্তিগত সম্পদ ও পরিবেশের যে ক্ষতিসাধিত হয়, তার বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দাবি উঠে আসতে থাকে, যার কারণে নাইকো চাপের মধ্যে পড়ে। তবে নাইকো তার নিজস্ব পথেই সমস্যা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নাইকো তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে এক কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল গাড়ি ঘুষ হিসেবে প্রদান করে। এর লক্ষ্য ছিল বহু কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবিকে ঠেকানো, কমানো ও বিলম্বিত করতে নাইকোর পক্ষে কাজ করা। কিন্তু বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে প্রতিমন্ত্রী গাড়ি ও মন্ত্রিত্ব দুটোই হারান।
২০০৫ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত জনৈক আইনজীবী এহসানুর রহমান নাইকোর বিরুদ্ধে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র এলাকার টেংরাটিলা, আজবপুর ও গিরীশপুর গ্রামের ১০০০ জন গ্রামবাসীর পক্ষে টেক্সাস কোর্টে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। তবে নাইকোর সুকৌশলী আইনজীবী ঘটনার স্থান বা বিবাদী কোম্পানি কোনোটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা না থাকার সুবাদে মামলাটি আদালত থেকে বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ আইনজীবীদের সংস্থা বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) ঢাকায় উচ্চ আদালতে নাইকোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যৌথ চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ এবং নাইকো কর্তৃক দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবিতে নাইকোর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত নাইকো কর্তৃক ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের মূল্য পরিশোধ বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেন।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে। কিন্তু স্থানীয় কোর্টে দায়ের করা এ মামলাগুলোর মাধ্যমে নাইকো কোম্পানিকে কিছুতে বাধ্য করার কোনো উপায় নেই বলে প্রতীয়মান হয়। জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোনো বিবদমান পরিস্থিতি মেটানোর জন্য দুপক্ষ পারস্পরিক সমঝোতার চেষ্টা করবে। তা ব্যর্থ হলে একজন বিশেষজ্ঞের অধীনে সমঝোতা করবে। তাও সম্ভব না হলে পরবর্তী পন্থা চুক্তির শর্তে এভাবে বর্ণিত: আর্টিকেল ১৮.৫: ‘...সাচ ডিসপিউট শ্যাল বি রেফার্ড টু দি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট (আইসিএসআইডি)। ইফ ফর অ্যানি রিজন, আইসিএসআইডি ফেইলস টু টেক দ্য জুরিসডিকশন ওভার সাচ ডিসপিউট, দ্য ডিসপিউট শ্যাল বি ফাইনালি সেটেল্ড বাই ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স।’
বাংলাদেশ নাইকোর সঙ্গে বিবাদ মেটানোর জন্য ইতিপূর্বে না আদালতের বাইরে একক আরবিট্রেটর মাধ্যমে সচেষ্ট হয়েছে, না আইসিএসআইডি আদালতে মামলা দায়ের করেছে। নাইকোকে বিবাদী করে আইসিএসআইডি ট্রাইব্যুনালে মামলা না করে বর্তমানে বাংলাদেশ সেখানে নাইকোর করা মামলায় বিবাদী হয়ে মামলা লড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ মামলায় বাংলাদেশের জিতে আসার সম্ভাবনা কেমন? পর্যবেক্ষকেরা একমত পোষণ করেন যে মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তিসমূহ যথেষ্ট যৌক্তিক ও বিজ্ঞ আইনজীবীদের পক্ষে এ মামলা বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আনা সম্ভব। মূল দুটি বিষয় হলো, দুর্ঘটনার দায় ও ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে চুক্তির শর্ত।
ছাতক গ্যাস দুর্ঘটনার পর সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল এই যে দুর্ঘটনার দায় পুরোপুরি নাইকোর অবহেলা ও অদক্ষতা। অধিকন্তু ২০০৫ সালে টেক্সাস কোর্টে দায়ের করা ক্ষতিপূরণ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাদী পক্ষের (এক হাজার গ্রামবাসী) আইনজীবী দুর্ঘটনার প্রাক্কালে নাইকো কর্মকর্তা ও খননকর্মীদের পারস্পরিক অভ্যন্তরীণ ই-মেইল হস্তগত ও ফাঁস করার মাধ্যমে সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন যে কোম্পানির কর্মীরা নিজেরাই তাঁদের খননকর্মকে অদক্ষ ও বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করে একে অপরকে দোষারোপ করেন।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে নাইকোর সঙ্গে যৌথ চুক্তির ধারা সুস্পষ্ট। চুক্তির শর্ত এভাবে বর্ণিত: আর্টিকেল ২১.১: ‘অপারেটর শ্যাল অবটেইন ইনস্যুরেন্স কভারেজ ফর পেট্রোলিয়াম অপারেশন ফর রিস্ক অ্যাজ আর কাস্টমারিলি ইনসুরড ইন দি ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম প্রাকটিসেস। দ্য সেইড ইনস্যুরেন্স শ্যাল কভার, ক. লস অর ডেমেজ টু অল ইনস্টলেশন, ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদার অ্যাসেটস ইন কানেকশন টু পেট্রোলিয়াম অপারেশন, খ. লস, ডেমেজ অর ইনজুরি কজড বাই পলিউশন ইন দ্য কোর্স অর অ্যাজ এ রেজাল্ট অব পেট্রোলিয়াম অপারেশন, গ. লস অব প্রোপার্টি অর ডেমেজ অব বডিলি ইনজুরি সাফারড বাই এনি থার্ড পার্টি ইন দ্য কোর্স অব অর অ্যাজ এ রেজাল্ট অব পেট্রোলিয়াম অপারেশন ফর হুইচ দি অপারেটর মে বি লায়েবল। উপরিউক্ত শর্তের শেষ অংশটিতে থার্ড পার্টি বলতে এ ক্ষেত্রে গ্রামবাসীকে বোঝাবে। সুতরাং চুক্তির শর্তে গ্যাস সম্পদ, অন্য সম্পদ ও গ্রামবাসীর ব্যক্তি সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার বিপরীতে নাইকো কর্তৃক সমূহ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সুস্পষ্ট।
নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে বাংলাদেশ সিমিটার তেল কোম্পানি ও শেভরন তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে দুটি মামলায় জয়লাভ করে। বাংলাদেশে নাইকোর কার্যক্রম অসৎ ভিতের ওপর নির্ভর করে চালিত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট তথ্যগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন করে দেশের আইনজীবী প্রতিনিধিদল এ মামলার রায়কে জনগণের পক্ষে নিয়ে যেতে পারবে, সে আশা সবার।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.